পরীক্ষা ভীতিমুক্ত পাঠক্রমে খেলার ছলে শেখা

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে, বুঝে-না বুঝে এমনকি হালের রাজনীতিতেও ঢুকে গেছে এই আলোচনা। বিশেষ করে কোচিং, গাইড এবং নোটবুক বিক্রেতারা এ ব্যাপারে খুবই সরব হচ্ছে। এই আলোচনা-সমালোচনা, কি আছে নতুন শিক্ষাক্রমে, দিনশেষে এই শিক্ষাক্রমের কি বার্তা, তা এবার আলোচনা করা যাক। জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, যোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীরা আলোচ্যসূচি থেকে পাঠ করে চোখের দৃষ্টিতে অনুধাবন বা দৃশ্যায়ন (ভিজুয়ালাইজেশন) করতে পারবে।

ফলে  স্কুলে সে যা শিখছে কিংবা অনুধাবন করে এসেছে, তাই সে কর্মক্ষেত্রে, শিল্প-কারখানায় এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে। অর্থাৎ মুখস্থ ও পীড়াদায়ক শিখন পদ্ধতির পরিবর্তে হাতে-কলমে এবং আনন্দময় শিখন পদ্ধতি এখানে প্রবর্তন করতে চেষ্টা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভবিষ্যতে যে ডাক্তার হবে তার ভাষার ওপর তেমন দক্ষতা দরকার নেই। কিংবা যে সাহিত্যিক হবে সে কেমিস্ট্রিতে ভালো নম্বর না পেলেও  চলবে। অথবা, যে ক্রীড়াবিদ হবে সে পাঠ্যসূচিতে যাই থাকুক না কেন, তাকে নজর দিতে হবে তার শরীর ও স্বাস্থ্যের দিকে।

কিন্তু প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সবকিছুই  শিক্ষার্থীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, সেখানে সফট স্কিলড এবং দলবদ্ধভাবে শেখার তেমন কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান পদ্ধতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক  শিখন পদ্ধতি বাদ দিয়ে দলবদ্ধ এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক সফট স্কিলড চর্চা অবধারিত করা হয়েছে। ফলে খেলার ছলে শেখা বা সহজলভ্য শিখন পদ্ধতির নানা উপকরণ থাকায় পরীক্ষাভীতি থাকছে না।
এভাবে নতুন পাঠ্যসূচিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী যা শিখছে, শিক্ষক সবই ধারাবাহিক মূল্যায়নের আওতায় আনছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর হোমওয়ার্ক বা এসাইনমেন্টে ভুলত্রুটি, ঝুঁকি কিংবা অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় শিক্ষক প্রয়োজনীয় গাইড দিচ্ছেন। শিক্ষার্থী তা আবার সংশোধন করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীর কোচিং বা নোট বইয়ের নির্ভরতা কমবে। শিক্ষা ব্যয়ও সঙ্কুচিত হবে। এভাবে হাতে-কলমে আয়ত্ত করার ফলে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা হিসেবে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও চাকরির যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। ধর্মীয়, সংস্কৃতি ও অন্যান্য মূল্যবোধের বিষয়গুলো একইভাবে পাঠক্রমে সন্নিবেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেম এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারবে।
বর্তমান শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন (Experiencial Learning) পদ্ধতিকে। এ পর্যয়ে শিক্ষার্থীর চাহিদা, রুচি এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরিচালিত শিখনকে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষণ বলা হয়। এর মূল কথা হলো, শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে নানা ধরনের প্রত্যক্ষ কাজের মাধ্যমে পরিবেশন করা। শিক্ষার্থীরা সেই কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই শিখবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মূল দিক হলো শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে শিখনের বিষয়গুলোর সমন্বয় ঘটানো।

যাতে শিখন সহজ আনন্দময় ও অর্থবহ হয় এবং তারা বাস্তব জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ ঘটাতে পারে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই বর্তমান শিক্ষাক্রমকে সাজানো হয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ, সুষ্ঠুভাবে পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং সূক্ষ্মচিন্তনের প্রতিফলনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। ফলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে অর্জিত এই জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে।
এখানে বাস্তব ও প্রয়োগভিত্তিক আরও কয়েকটি বিষয়ে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- ১. প্রেক্ষাপট নির্ভর শিখন (Concrete Experience)– শিক্ষার্থী পাঠের বিষয়ের সম্পর্কিত তার নিজস্ব ধারণা, মতামত ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করবে।

অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। সে জন্য যে বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করানো হবে, সে বিষয়ে শিক্ষক একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা (Concrete Experience) এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাবে। এটি হতে পারে শিক্ষার্থীর নিজের অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতা বা চার পাশের প্রত্যক্ষ ঘটনাবলি। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল কন্টেন্ট বা অভিনয়ের মাধ্যমেও বাস্তব উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে কোনো একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেতে পারেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কোনো একটা বিষয় কিছু পূর্বজ্ঞান বা পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে। যদি ওই বিষয়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নাও থাকে, তখন  বিষয়টির অডিও-ভিডিও কিংবা দৃশ্যায়ন দেখার পর সেটি উপলব্ধি ও অনুধাবন করে থাকে। আর এটিই হচ্ছে প্রেক্ষাপট নির্ভর শিখন পদ্ধতি।
২. প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ (Reflective Observation)– পর্যবেক্ষণ আলোচনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী অন্যের সঙ্গে নিজের ধারণা মতামত ও অভিজ্ঞতা যাচাই করবে অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে চিন্তা করবে। এভাবে পূর্ব অভিজ্ঞতাকে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলন করে শেখার যে ধাপ সূচনা হয়, তা হলো প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ। শিক্ষার্থীকে কিছু সময়ের জন্য অর্জিত অভিজ্ঞতার বিষয়টি নিয়ে ভাবার সুযোগ তৈরি করে দিতে হয়। অর্জিত অভিজ্ঞতার ওই দৃশ্যের (লে-আউট), পরিবেশ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে শিক্ষার্থীর মনে যে দাগ কাটে, তা কল্পনা করে সে তখন আরেকটি ওই রকম দৃশ্য তৈরি করতে সমর্থ হয়।
৩. বিমূর্ত ধারণা (Abstract Concept) –  পাঠের বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থী নিজস্ব ধারণায় উপনীত হবে অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানবে। এ পর্যায়ে বিশেষ একটি বিষয়ের প্রয়োজনীয় তথ্য, তত্ত্ব এবং সহায়ক উপকরণের সাহায্যে শিক্ষার্থীর ভাবনাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবেন শিক্ষক। শিক্ষার্থী উপকরণ দেখেই সক্ষম হবে যে, তাকে কি করতে হবে। এর সঙ্গে সে যুক্ত করবে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা। এই দুইয়ের অভিজ্ঞতায় এবং তার নিজের কল্পনা শক্তির সহায়তায় সৃষ্টি হবে কাক্সিক্ষত দৃশ্যায়ন বা ফলাফল যা শিক্ষক চেয়েছিলেন তার কাছ থেকে।

৪. সক্রিয় পরীক্ষণ (Active Experimentation)- অর্জিত ধারণা কোনো নতুন বা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাতে-কলমে অনুসরণ করবে অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা নিজে প্রয়োগ করবে। এ জন্য শিক্ষক কোনো একটি বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর শিখনকে প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি করে দেবেন। অতঃপর শিক্ষার্থী তার অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান বাস্তবে প্রতিফলন ঘটিয়ে দেখায়। সে তার বুদ্ধি, চিন্তা ও বিবেচনা কাজে লাগিয়ে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু সফলভাবে করতে সক্ষম হয়। সহজ কথা, তথাকথিত মুখস্থ বিদ্যা পরিহার করে অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে কোনো বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে পারাটাই হচ্ছে সক্রিয় পরীক্ষণ।
চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৬৫% কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই শিল্পবিপ্লবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelegence) এমনভাবে আবির্ভূত হবে যে, এর প্রভাব পড়বে মানুষের কর্মজীবনে, তার পেশাগত পরিসরে। এখন যে সব শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র কেমন হবে? তাদের পেশা কি হবে তা অনেকটাই অজানা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান প্রক্রিয়া পরিবর্তিত ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রাখা হয়েছে।

সমস্ত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষার ওপর চাপ কমিয়ে পড়ালেখাকে ব্যবহারিক ভাষায় আদান-প্রদান করত কর্মমুখী  রাখার  সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতার চাইতে সহযোগিতার বিষয়ে অনেক উদার ও মানবিক হবে। সার্বিকভাবেই একটি ভালো শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে এটাই সবচেয়ে ভালো এমনটিও নয়। অনেক কিছুই হয়তো সন্নিবেশ করা সম্ভব হয়নি, যা মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার আলোকে সংযোজন করার সুযোগ আছে ভবিষ্যতে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব আছে নিশ্চয়ই।

সেটাও দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। কোচিং এবং গাইড বই বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নেতিবাচক সমালোচনা বর্জন করে ইতিবাচক সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। একটি চারা গাছের ফল পেতে যেমন সময় লাগে, তেমনি পরীক্ষা ভীতিমুক্ত নতুন শিক্ষাক্রমের সফলতা আসতেও কয়েক বছর সময় লাগবে। ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়