আমাদের উৎসবের অর্থনীতি

কদিন আগে উদযাপন হলো বাংলা নববর্ষ। সামনে রোজার ঈদ বা ঈদুল ফিতর। বিগত দুটি বছরে করোনা সংকটের কারণে বাংলা নববর্ষ কিংবা ঈদ কোনো উৎসবই পুরোদমে পালন করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সরকারের টিকা ও আর্থিক প্রণোদনা ব্যবস্থাপনাকে সে জন্য কৃতিত্ব দিতেই হবে। আর এ কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে জেগে ওঠার বাতাস বইছে। মার্চ মাসে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়- দুই-ই বেশ বেড়েছে। এই আয় আমাদের ভোগের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছে। এবার তাই বাংলা নববর্ষ এবং রোজার ঈদকে ঘিরে জনসাধারণের আগ্রহ-উদ্দীপনা বেশি থাকবে তেমনটিই ভাবা হয়েছিল। এই উৎসব উদযাপনের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তো রয়েছেই। এগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব ও গুরুত্বও আলাদা মনোযোগের দাবি রাখে। বিশেষত একদিকে করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চলমান থাকা এবং অন্যদিকে বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে যে চাপ রয়েছে তার প্রেক্ষাপটে এই উৎসবগুলোকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্লেষণ আরও বেশি জরুরি। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকে বেশি করে জোর দেয়ার কথাও কেউ কেউ বলছেন। তবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গতিময়তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদার যে গভীর সম্পর্ক আছে তা তো মানতেই হবে। সেই বিচারে বাংলাদেশ দুই পায়েই বেশ আস্থার সঙ্গে হাঁটছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের কৃষির সাফল্য। আর অর্থনীতির এই ত্রয়ী শক্তির প্রভাবে দেশের মানুষের অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদা- দুই-ই বাড়ন্ত। এ সবের প্রভাব তো উৎসবের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটা নির্ধারণ করবেই।

যে দুটি উৎসবের কথা বললাম দুটির ক্ষেত্রেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদাটিই মুখ্য বিবেচ্য। আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে রপ্তানি যতটা মনোযোগ পায়, আমি লক্ষ করেছি অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ ততটা গুরুত্ব এখনো পাচ্ছে না। এর একটি কারণ হতে পারে দেশের অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিকতা। অনানুষ্ঠানিকতার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা এবং সেই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে হিসাব করা জটিল বটে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্যের ঘাটতি যে আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবুও একে কম গুরুত্ব দেয়া সমীচীন নয় মোটেও। রবীন্দ্রনাথ সব সময় সমাজের ‘আত্মশক্তি’র ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। একইভাবে বঙ্গবন্ধুও বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে দেশকে আত্মনির্ভরশীল করার পক্ষে ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর তার নেয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপ থেকে শুরু করে, তাঁর তৈরি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও এমন জোরই দেখি। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও একই পথে হেঁটে মন্দা মোকাবেলা করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছিলাম। সে সময়ও আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেগবান করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম। ঋণপ্রবাহ যেন ‘রিয়েল ইকোনমি’তে যায় তা নিশ্চিত করতে কৃষি, কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই), এবং নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেগবান করা সম্ভব হয়েছিল এবং আমরা কেবল বৈশ্বিক মন্দা ভালোভাবে মোকাবেলা করেছিলাম তাই নয়, বরং অর্থনীতিতে নতুন গতিও সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে শুরু করা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ওই ‘নীরব বিপ্লব’ একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সফল হয়েছে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তার একযুগ পরে আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি আবারও একই রকম চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবারও অভ্যন্তরীণ চাহিদাই আমাদের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। সে বিচারেই এবারের বাংলা নববর্ষ আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে দেখুন এই সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উদযাপনকে কেন্দ্র করে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় ঝিমিয়ে পড়া খাতগুলোতে গতি সঞ্চার হলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য কতটা ইতিবাচক হতে পারে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের কথা না হয় নাই বললাম, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ যারা, ধরা যাক গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা তারা সবাই যদি পরিবারের জন্য নববর্ষ উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করেন তাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। গ্রামেও তো এখন সেবা খাতের ব্যাপ্তি অনেক। আয়ের ৬০ শতাংশই আসছে অকৃষি খাত থেকে। কাজেই নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামের অকৃষি খাতের উদ্যোক্তারাও বাড়তি বেচাকেনার মুখ দেখবেন। দেশব্যাপী টাকার এই লেনদেনের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও আয়-রোজগার বাড়বে। তাদের জন্য নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির চাপ মোকাবেলা কিছুটা হলেও সহজতর তো হবেই। করোনার দুর্দশা কাটিয়ে দুই বছর বাদে পুরো মাত্রায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন অর্থনীতির জন্য সুখবরই বটে।

বিশেষ করে দেশীয় কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য বাংলা নববর্ষ উদযাপন বেশি সহায়ক হবে বলে মনে করি। উদাহরণ হিসেবে দেশের ছোট ছোট পোশাক প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারীদের কথা ধার যায়। ১০-১৫ বছর আগেও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক কেনা অত বেশি ছিল না। কিন্তু করোনা আসার আগে আগে ২০১৯ সালের পহেলা বৈশাখকে ঘিরে ১৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি। এই পোশাক কিন্তু কেবল বিপণি বিতানে বিক্রি হয়েছে এমন নয়। বরং ফুটপাথের বিক্রেতাসহ অনানুষ্ঠানিক বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও এর একটি বড় অংশ বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালের আগের হিসাব বলছে এই বিক্রির পরিমাণ বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। করোনাকালে এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চয়ই ধাক্কা খেয়েছে। তবে এবারের নববর্ষে নিশ্চয়ই আমরা পুরোপুরি আগের ধারায় না ফিরলেও গত দুই বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পোশাক বিক্রি বাড়তে দেখব। কেবল ছোট পোশাক প্রস্তুতকারকরাই নন, বড় বড় ফ্যাশন হাউসগুলোও জানিয়েছে যে তাদের মোট বিক্রির এক-চতুর্থাংশের বেশি হয় এই বাংলা নববর্ষেই। আর শুধু পোশাক বিক্রি কেন, হালখাতা অনুষ্ঠানের জন্য মিষ্টি দোকানের যে ব্যবসা হয় তাও তাদের সারা বছরের বিক্রির চার ভাগের এক ভাগ। সরকারের ‘আমার গ্রাম আমার শহর’নীতি আর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কারণে গ্রামাঞ্চলে উৎসবকেন্দ্রিক চাহিদা দ্রুত আরও বাড়বে। ফলে আগামীতে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর মধ্যবিত্তের রেস্তোরাঁয় খাওয়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে তারও প্রভাব অভ্যন্তরীণ ভোগ-বাণিজ্যে নিশ্চয় পড়বে।

আর মাত্র কয়েক দিন পরেই ঈদুল ফিতর। কাজেই বলা যায় চলতি এপ্রিল মাসের পুরো দ্বিতীয়ার্ধজুড়েই বাজার সরগরম থাকবে। চারদিকে কেনাকাটা অনেকটাই জমে উঠেছে। ঈদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুফলও পৌঁছে যাবে সব স্তরে। ফলে অর্থনীতির গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই দুটি সপ্তাহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ব্যবসায়ীরা, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এবং নতুন যুক্ত হওয়া অনলাইন উদ্যোক্তারা যেন এ সময়টায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন সে জন্য সর্বাত্মক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক চরিত্রের কারণেই হোক বা অন্য কারণে হোক এখনো উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যথাযথ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। এদিকটিতে এখনই নজর দেয়া চাই। উৎসবের কেনাবেচার ধারা ভালোভাবে লক্ষ্য করে সে অনুসারে নীতি-উদ্যোগ নিতে পারলে আগামীতে উৎসবে উদ্যোক্তাদের জন্য আরও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। সরকার বাজার মনিটরিং এবং সাপ্লাই চেইন মেরামতের কাজ মোটামুটি ভালোই করছে। এর ইতিবাচক প্রভাব উৎসবের বাজারের ওপর পড়তে শুরু করেছে। আমাদের উৎসবের অর্থনীতির কলেবর বরাবরই অনেক বড়। ঈদের আগে নতুন কোনো প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশ তৈরি না হলে নববর্ষ ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতির ধারায় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা নিজেদের বেশ গুছিয়ে নিতে পারবে। সবাইকে অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা।

লেখক: ড. আতিউর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।