সহজে কৃষিঋণ প্রাপ্তি এবং কৃষকের স্বস্তি

কৃষকের সন্তান এখন আর কৃষক হয় না। কৃষিজমির পরিমাণও কমে আসছে। তবে কৃষির ওপর ভিত্তি করে আজও আমরা আমাদের সুখ-দুঃখের হিসাব-নিকাশ করে থাকি। দেশে কৃষির উৎপাদন কমে গেলে সারা দেশের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। সমস্যাটি শুধু কৃষকদের থাকে না, সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে। কৃষি দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এবং শ্রমশক্তির ৫৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে কৃষিতে নিয়োজিত। এ কারণেই কৃষকের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে সরকার কৃষিতে ভর্তুকি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে।

তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষক অশিক্ষিত। যে কারণে তাঁরা কাগজপত্র-সংশ্লিষ্ট কাজগুলো এড়িয়ে চলতে ভালোবাসেন। কোনো মৌসুমে ফসল ভালো হলে হাতে বেশ কিছু টাকা আসে। কিন্তু সঞ্চয়ের মাধ্যম না থাকায় সেই টাকা খরচ করে ফেলেন। আবার কোনো মৌসুমে ফসল না হলে দুঃখ যেন অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরে। কৃষকদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য স্বল্প আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে এই হিসাবের মাধ্যমে তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণও নিতে পারছেন। যে কারণে মহাজনের করাল থাবা থেকে অনেক অসহায় কৃষকই রক্ষা পাচ্ছে। নির্যাতনের হারও হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালায় কৃষিঋণ বিতরণের জন্য যে পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি অত্যন্ত কৃষি ও কৃষকবান্ধব। নীতিমালায় বর্ণিত কৃষিঋণ বিতরণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় হচ্ছে—

ক) ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লী ঋণের আবেদনকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের ভিত্তিতে প্রকৃত কৃষক শনাক্ত করবে। কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের বিপরীতে মাত্র ১০ টাকা জমা গ্রহণপূর্বক খোলা অ্যাকাউন্টধারী কৃষকদের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শুধু পাস বইয়ের ভিত্তিতেই প্রকৃত কৃষক শনাক্ত করা যেতে পারে। জাতীয় পরিচয়পত্র আছে কিন্তু কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড নেই, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা স্থানীয় স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক অথবা ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির দেওয়া প্রত্যয়নপত্রও প্রকৃত কৃষক শনাক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।

খ. কৃষিকাজে সরাসরি নিয়োজিত প্রকৃত কৃষকরা কৃষিঋণ প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। পল্লী অঞ্চলে আয় উৎসারী কর্মকাণ্ডে জড়িতরাও কৃষি ও পল্লী ঋণের সংশ্লিষ্ট খাতে ঋণ সুবিধা পেতে পারেন।

গ. বাংলাদেশের সাধারণ কৃষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফরম পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সময়, ফরমে যাচিত তথ্যের ব্যবহার তথা উপযোগিতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো কৃষিঋণের, বিশেষ করে শস্য বা ফসল ঋণের আবেদন ফরম সহজীকরণের উদ্যোগ নেবে। আবেদন ফরম পূরণসহ আনুষঙ্গিক কাজে যাতে কালক্ষেপণ না হয় সে জন্য আবেদন ফরম গ্রহণের সময়ই গ্রাহককে এতদসংক্রান্ত সব ধরনের নির্দেশনা দিতে হবে। সহায়ক কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে মাত্র একটি বৈঠকেই সব তথ্য গ্রাহককে জানাতে হবে।

ঘ. সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখা নির্ধারিত ঋণ নিয়মাচার অনুযায়ী আবেদনকারীর বার্ষিক প্রয়োজনীয় ফসল ঋণ ও অন্যান্য ঋণ এককালীন মঞ্জুর করবে। তবে সংশ্লিষ্ট ফসল উত্পাদনের মৌসুম শুরু হওয়ার অন্তত ১৫ দিন আগে ঋণ বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখাগুলো কৃষকদের বার্ষিক ফসল উৎপাদন পরিকল্পনাসহ আবেদনপত্র গ্রহণ করবে। প্রয়োজনবোধে, পরে কৃষকদের বার্ষিক উৎপাদন পরিকল্পনায় যুক্তিযুক্ত পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যাবে। গ্রাহকের আবেদনপত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করতে হবে। আবেদনপত্র প্রাপ্তির পর ঋণ মঞ্জুরি ও বিতরণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান যৌক্তিকীকরণ এবং গ্রাহকের কোনো অভিযোগ থাকলে তা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে শস্য ও ফসল চাষের জন্য ঋণের আবেদন দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঋণের আবেদন নিষ্পত্তিকরণের সময়সীমা হবে আবেদনপত্র জমার দিন থেকে সর্বোচ্চ ১০ কর্মদিবস।

ঙ. কৃষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ১০ টাকা প্রাথমিক জমার বিনিময়ে হিসাব খোলা যাবে। হিসাবগুলোর লেনদেন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসব হিসাবের ওপর সুদহার সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবের চেয়ে ১-২ শতাংশ বেশি হারে দেওয়ার বিষয়টি ব্যাংকগুলো বিবেচনা করবে। ব্যাংক শাখাগুলো এ ধরনের হিসাবে রক্ষিত সঞ্চয়ের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। এ হিসাবগুলোয় ন্যূনতম ব্যালান্স রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা এবং কোনোরূপ চার্জ বা ফি আরোপ করা যাবে না। এ ধরনের হিসাবে এক লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক বা লেভি কর্তন রহিত করা হয়েছে।

চ. ফসল উত্পাদনের জন্য একজন কৃষককে সর্বোচ্চ ১৫ বিঘা (৫ একর বা ২ হেক্টর) জমি চাষাবাদের জন্য নিয়মাচারে নির্ধারিত হারে ঋণ দেওয়া যাবে।

ছ. শুধু শস্য বা ফসল চাষের জন্য সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণের ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্টের প্রয়োজন পড়বে না। তবে খেলাপি ঋণগ্রহীতা যাতে কৃষিঋণ না পায়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঋণ বিতরণকারী ব্যাংককে নিশ্চিত হতে হবে। সাধারণভাবে পাঁচ একর পর্যন্ত জমিতে চাষাবাদের জন্য ফসল ঋণের ক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট ফসল দায়বন্ধনের বিপরীতে ঋণ দেওয়া যাবে। তবে পাঁচ একরের বেশি জমি চাষাবাদের জন্য ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানত গ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি ব্যাংক বা অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের প্রচলিত শর্তে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে। কৃষি ও পল্লী ঋণ কর্মসূচির আওতায় আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রুপ বা ব্যক্তিগত গ্যারান্টি গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত দুটি ব্যাংক, ৩৮টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ৯টি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশে মোট ১৭ হাজার ৬৪৬ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১০৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। ঋণ বিতরণের এ পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় এক হাজার ৬৬৭ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা বেশি। ব্যাংক ছাড়াও বিআরডিবি কর্তৃক ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৭৪ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সুপরিকল্পিতভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে কৃষকের জন্য নির্ধারিত ঋণ প্রকল্পগুলো। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। একুশ শতকের এ বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব পরিবেশ আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অথচ বেঁচে থাকতে হলে খাদ্যের বিকল্প নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য কৃষকের সমস্যার সমাধান সব কিছুর আগে প্রয়োজন। আমাদের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা অত্যন্ত কৃষিবান্ধব এবং কৃষকবান্ধব। কৃষকের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাংক আজ কৃষকের দোরগোড়ায়। তবে প্রকৃত কৃষকরা যেন ঋণ পায় এবং ঋণের যেন সদ্ব্যবহার করে, সেদিকে ঋণ প্রদানকারী সংস্থাকে অবশ্যই তদারকি করতে হবে। প্রতিনিয়ত সহজ করা হচ্ছে ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া। সমন্বিত উদ্যোগের কারণে কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। তার পরও কৃষি ও পল্লী ঋণসহ ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সেবা পেতে গ্রাহকদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করা কিংবা তাদের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্রাহকস্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কৃষকরা যেকোনো ফোন থেকে ১৬২৩৬ হটলাইন নম্বরে ফোন করে সরাসরি তাঁদের অভিযোগ জানাতে পারবেন। সব পদক্ষেপ দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য। কারণ কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষক ভালো থাকলেই, ভালো থাকবে দেশ।