স্বাস্থ্য মানুষের অমূল্য সম্পদ। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে,’স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ যার স্বাস্থ্য ভাল তার সবকিছু ভাল। একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষের মনে থাকে সব সময় কর্মচঞ্চলতা। সে হেসে- খেলে যেকোন কর্ম মনের আনন্দে করে যায়। অলসতা তার ধারে কাছে আসতে পারে না। আর যে মানুষের মনের মধ্যে কর্মচঞ্চলতা থাকে সে তার জীবনে উন্নয়নের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছতে পারে অতি অনায়াসে। স্বাস্থ্যহীন মানুষ তার কর্মজীবনে সফলতা লাভ করতে পারে না। কারণ তার সংসারে সব সময় রোগ-ব্যাধি লেগেই থাকে। ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে সে শূন্য হয়ে যায়। যার কারণে অভাব তার পিছু ছাড়ে না। তাছাড়া স্বাস্থ্যহীন লোকেরা কোন কর্ম করতে পারে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্রামীণ অবহেলিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা শতভাগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রশাসনের সর্ব নিম্নস্তর ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যেখান থেকে গ্রামের অবহেলিত জনগোষ্ঠী অতি সহজে তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। তাছাড়া আরও উন্নত সেবার জন্য দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে একজন করে মেডিকেল অফিসার (এমবিবিএস ডাক্তার) নিয়োগ দিয়েছেন। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং ভিশন ২০২১ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের অগ্রযাত্রা। এটা সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আলোকবর্তিকা। সমপ্রতি দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প বা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প। জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবেও আলোচিত। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফরে এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগকে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দেয়। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ (কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিপ্লব) নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে। গ্রামীণ জনগণের অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা বিতরণে প্রথম স্তর কমিউনিটি ক্লিনিক। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এখানে কর্মরত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন, যেমন- স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সেবা সম্পর্কে উদ্বুদ্ধকরণ; প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবা প্রদান; মা ও শিশুর খাদ্য ও পুষ্টির বিষয়ে সহায়তা প্রদান; ছোঁয়াচে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিষয়ে পরামর্শ দান এবং জটিলতর রোগের চিকিৎসার জন্য উপজেলা ও জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রেরণ।
ক্লিনিকে আগত সেবা গ্রহণকারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশন, সুষম খাদ্যাভ্যাস, টিকার সাহায্যে রোগ প্রতিরোধ, কৃমি প্রতিরোধ, বুকের দুধের সুফল, ডায়রিয়া প্রতিরোধ, পুষ্টি সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে বিনামূল্যে প্রায় ৩২ ধরনের ওষুধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টি সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসব-পূর্ব (প্রতিরোধ টিকা দানসহ), প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবা। এছাড়া সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যাথা, কাটা/ পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সময়মতো প্রতিষেধক টিকা যেমন- যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদিসহ কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়।
১৫-৪৯ বছর বয়সের সন্তানধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মায়েদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন, জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে শিশুর জন্মনিবন্ধন, এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ৬ মাস পর পর প্রয়োজনীয় ভিটামিন-এ খাওয়ানো এবং রাতকানা রোগে আক্রান্ত শিশুদের খুঁজে বের করা ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারগণ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণকারীদের জটিল কেইসগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানপূর্বক দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করেন।
শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহে ৬ দিন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবা প্রদান করেন। স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ সপ্তাহে ৩ দিন করে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসেন। কে কোন দিন বসবেন তা স্থানীয়ভাবে ঠিক করা হয়। অফিস সময় সকাল ৯ থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারগণ স্বাস্থ্য সহকারীদের তদারকি করবেন। প্রশাসনিক কর্ম এলাকায় (প্রতি ইউনিয়নে ৯টি) ওয়ার্ডভিত্তিক মাঠকর্মীদের পদায়ন করা হয়। যদি কর্মীর সংখ্যা বেশি হয় তবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে তা সমন্বয় করে পদায়ন করা হয়।
স্বাস্থ্য সহকারী অথবা পরিবার কল্যাণ সহকারী একে অপরের অনুপস্থিতিতে কমিউনিটি ক্লিনিকে সকল সেবা নিশ্চিত করেন। কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য স্বাস্থ্য সহকারী এবং পরিবারকল্যাণ সহকারী বাড়ি পরিদর্শনকালীন সময়ে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদানে সক্রিয়ভাবে কাজ করে থাকেন।
যে সব গর্ভবতী মহিলা কমিউনিটি ক্লিনিক হতে প্রসবপূর্বক ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারীগণ তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। এছাড়া যে সব নারী-পুরুষ ইপিআই, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ্য ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সেবা গ্রহণ করেননি তাদেরও এ সেবা ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম সফল, শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রেফারেল সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ৮০ ভাগ এলাকাবাসী সেবা নেয়, আর গড়ে প্রতিদিন সেবা নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৫। ক্লিনিক-লো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনামূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন এই সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে এ মূল্যায়নটি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (ওগঊউ)। ২০১৩ সালে তৈরি এ মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি গত বছরের প্রথম দিকে প্রকাশ করা হয়। সরকারের পৃথক দুটি জরিপেও এসব ক্লিনিক নিয়ে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। তবে ওগঊউ এর প্রতিবেদনে ক্লিনিকগুলোর দুর্বল দিকও চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশের ৫৭ শতাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকের দরজা, জানালাসহ ভবনের অবকাঠামোগত অবস্থা ভালো নয়। ৪০ শতাংশ ক্লিনিক সুপারিশ করা নকশা অনুযায়ী তৈরি হয়নি। ৪২ শতাংশের নলকূপ অকেজো ও ৩৬ শতাংশের শৌচাগার নষ্ট। অনেক সেবাকেন্দ্রে নিরাপদ পানির জন্য টিউবওয়েল মেরামত ও নতুন টিউবওয়েল পুনঃস্থাপন করা দরকার। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের পদক্ষেপ যুগোপযোগী। ফলে আমরা সমস্যা-লোর আশু সমাধান পাবো বলে আশা করা যায়। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও একটি জায়গা থেকে মানুষ স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা পাচ্ছে এটা বিরাট ব্যাপার। কমিউনিটি ক্লিনিক তৃণমূল মানুষকে শুধু স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে না, স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত যে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে সেটা সার্বিক স্বাস্থ্য সূচকে ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্যসেবার এই সুবিধা অব্যাহত রাখতে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে আরও সম্পৃক্ত হতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৃনমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো স্থাপন করা হলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামীণ পর্যায়ের লোকজনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যাওয়ার জন্য। ক্লিনিকগুলোতে দায়িত্ব প্রাপ্ত লোকজনকে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। যাতে করে গ্রামের অবহেলিত কোন লোকজন ক্লিনিকে সেবার জন্য এসে ফিরে না যায়। তাহলেই সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার কাজ স্বার্থক ও সফল হবে।
মো. ওসমান গনি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট