বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট: প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও ‘নাই নাই’ কৌশল

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সম্পদের অবদান অনস্বীকার্য। সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে বাড়ছে মৎস্য উৎপাদন। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদিত হয়েছে ৪৯ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়েও বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে সে বছর রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মাছ। কিন্তু এর পরও ‘সাগরে মাছের আকাল’ এবং ‘আশানুরূপ মাছ মিলছে না’ অভিযোগ করে চলেছেন মাছ ব্যবসায়ী ও বোট মালিকরা। অথচ বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন বলে জানিয়েছে খোদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজারে নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগালের বাইরে রুপালি ইলিশ।

দেশের ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল। এ সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল মা ইলিশ রক্ষায়। যাতে ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে পদ্মা মেঘনা এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ চ্যানেলে মাছ ধরার নৌযানগুলো ইলিশ শিকারে নামে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও বিক্রেতাদের দাবি, মাছ কম। আকারে ছোট মাছ বেশি। খুচরা বিক্রেতা এবং অভয়াশ্রম অঞ্চলের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মাছ ব্যবসা পুরোটাই মহাজনী ব্যবসায় চালিত। এর সিন্ডিকেট বেশ লম্বা। ফলে মাছের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন সাহেবরা। এ সাহেব বলতে ‘দাদন ব্যবসায়ী’, ‘কোল্ড স্টোরেজ মালিক’ ও ‘নৌযান মালিকরা’। অবশ্য দেশের বেশিরভাগ মাছ ব্যবসায়ীই হল নৌযানের মালিক, পাশাপাশি দাদন ব্যবসায়ী। ফলে সামুদ্রিক মাছের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান প্রয়োজন, বলছেন প্রান্তিক জেলেরা।

ফিশারিঘাট বাজারের প্রবীণ কয়েক বিক্রেতা জানাল, আড়তদার ও বোট মালিকরা ‘মাছ কম’ এসব বলার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। সবচেয়ে বড় বিষয় ‘দাদন’ ও ‘অতিরিক্ত দাম।’

সরকার মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণের মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন এবং অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন উদ্বেগজনকভাবে কমে ১ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন হয়েছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমান সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় ইলিশের আহরণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। ইলিশের প্রাচুর্যতা থাকায় সর্বশেষ ২৩-২৪ অর্থবছরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমোদন দেয়। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৪১ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়। কিন্তু দেশের মৎস্য বিক্রেতা এবং বোট মালিকরা বেশ কৌশলে মাছ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে গলা কাটছে সাধারণ ক্রেতাদের।

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর আগ্রাবাদের তথ্যমতে, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১১ ভাগ ইলিশ, যা জিডিপিতে অবদান রাখছে ১ শতাংশ। প্রায় ৫ লাখ লোক সরাসরি ইলিশ আহরণে নিয়োজিত। ইলিশ আহরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ লোক জড়িত। বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। সারাবিশে^র মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ আহরিত হয় লাল সবুজের বাংলাদেশে। অথচ বোট মালিক ও পাইকার-আড়তদার সিন্ডিকেটের কব্জায় ইলিশের বাজার।

চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটের সুধীর জলদাস জানান, ইলিশের বাজার ফিশারিঘাট আর মাঝির ঘাটের বড়পাইকার ও কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এক কেজির ইলিশ বাজারে নেই। কিন্তু আড়তদারের স্টোরে মজুত থাকে। সুপার স্টোরে পাঠায়। অনলাইনে বিক্রি করে। আর দাদন তো আছেই। যারা দাদন নিয়ে সাগরে যায় তারা মূলত দিনমজুর। কিছু থাকে না। লাভ তো বোটের মালিকের।

সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার। তার কাছে ইলিশের বাজার কেমন জানতে চাইলে বরাবরের মতো এবারও বলেন, ‘ইলিশ নাই তো। বাজারে মাছ নাই। দাম বেশি।’ বাজার পরিস্থিতি ভালো না দাবি করেন তিনি। প্রায় শতাধিক বোট সাগরে গেলেও ইলিশ নিয়ে কোনো নৌযান ফেরেনি, দাবি তার।

চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট দেশের অন্যতম বৃহত্তর পাইকারি মাছের বাজার। সাগরের মাছের আধিক্য থাকে এ বাজারে। পদ্মা, মেঘনা ও খুলনা থেকেও নৌযান আসে মাছ নিয়ে এ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র্রে। কিন্তু বাজার যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয় সরকারের বিভিন্ন তদারকি ইউনিট। ফলে মাছের দাম থাকে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। শুধু তাই নয়, ফিশারিঘাট ঘিরে যেসব পাইকারের মৎস্য বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের প্রতিজনের কাছেই ইলিশ থাকে টনে টনে, যা বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে মজুত রাখা হয়। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে তা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিক্রি হয়।

ফিশারিঘাট বাজারে শুক্রবার সকালে ৬শ’ থেকে ৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে কেজি ১ হাজার টাকায়। শুধু তা-ই নয়, চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজার, বক্সিরহাট ও কাজির দেউড়ি বাজারেও আকার-মানভেদে ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১২শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। কিন্তু সমিতির নেতাদের দাবি ইলিশের বাজার ভালো না। মাছ নেই।

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর উন্নত পদ্ধতির প্রবর্তন ও নৌকা যান্ত্রিকীকরণের ফলে সামুদ্রিক জলাশয়ে ইলিশ মাছের আহরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীতে ড্রেজিং ও নাব্য বৃদ্ধি করে জলজ পরিবেশ দূষণমুক্ত করা হয়েছে। ফলে ইলিশের পরিভ্রমণ পথ, প্রজননক্ষেত্র, বিচরণ ও চারণক্ষেত্র (ফিডিং এবং নার্সারি গ্রাউন্ড) রক্ষা হয়েছে। এ ছাড়া কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল, বেড়জাল ও মশারি জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় ইলিশের বিচরণও বেড়েছে। এ ছাড়া ৬৫ দিনের এবং ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে সামুদ্রিক মাছ ও ইলিশের সংরক্ষণ এবং প্রজনন বৃদ্ধি পেয়েছে।

Views: 2