পয়ঃশোধনে দক্ষিণ এশিয়ার পথিকৃৎ বাংলাদেশ

আজ এসটিপি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

নানা ধরনের দূষণে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়ই শীর্ষে অবস্থান করে রাজধানী ঢাকা। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) বায়ুমানে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এই শহরে বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাস। পয়োনিষ্কাশন এই শহরের অন্যতম বড় সমস্যা হওয়ায় পয়ঃশোধনের ক্ষেত্রে আধুনিক ব্যবস্থায় মনযোগী হয়েছে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটি (ঢাকা ওয়াসা)। সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধন কেন্দ্র (এসটিপি) স্থাপন করেছে খিলগাঁওয়ের আফতাবনগরের দাশেরকান্দিতে। বাংলাদেশে এই ধরনের প্ল্যান্ট এটিই প্রথম, যা পয়ঃশোধনের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে পথিকৃৎ হচ্ছে বাংলাদেশ।

স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান
রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে সুদৃশ্য এই অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সমন্বিত আধুনিক ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন পয়ঃশোধন করা সম্ভব হবে। আজ বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) এসটিপিটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন পাগলার পয়ঃশোধনাগারের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হবে।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান জানিয়েছেন, এ ধরনের একক পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্ট দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম এবং এটিই সেরা। প্ল্যান্টটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও জনবান্ধব।

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, নর্দমা থেকে আনা পানি প্ল্যান্টের মাধ্যমে পরিশোধিত করে বালু নদীতে পড়ছে, যা নদীর পানির গুণগতমান বাড়াবে। এমনকি এই পানি সুপেয় করে তোলা সম্ভব হবে। আর এখান থেকে পাওয়া ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে তৈরি হবে সিমেন্ট। এ জন্য প্রয়োজনীয় ফ্লাই অ্যাশ, পয়ঃশোধনের উপজাত সিমেন্ট কারখানায় বিক্রি করা হবে। সেটি করা হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে।

এসটিপি (1)

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মহসিন আলী বলছেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই এখানে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টন ছাই পাওয়া যাবে। এই ছাই প্রসেসিং করা হলে ১০ শতাংশের মতো পাওয়া যায়। যার পরিমাণ প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ টন। এই ছাইটা সিমেন্ট কোম্পানিতে যাবে।

প্রতি তিন মাস পরপর ভারতীয় একটি কোম্পানির মাধ্যমে বিষয়টি চেক করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব। এটা হাতিরঝিল সমন্বিত একটি প্রকল্প অংশ। হাতিরঝিল করার সময় এটির ডাইভারশন লাইন করা হয়। সেই ডাইভারশন লাইন দিয়ে পয়ঃবর্জ্য ফেলা হতো রামপুরা খালে। ঢাকার অন্যতম এই জলাশয়কে বাঁচাতে প্ল্যান্টটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে, পরিবেশদূষণ কমাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পয়ঃশোধনের পর এখান থেকে দৈনিক ৪০ কোটি লিটার পরিশোধিত পানি (এফ্লুয়েন্ট) পাওয়া যাবে। যা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে নিষ্কাশিত হবে গজারিয়া খাল তথা বালু নদীতে। এর ফলে রামপুরা খালসহ বালু নদী ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানির মানের আরও উন্নতি হবে। প্ল্যান্টটি ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। ‘এসডিজি লক্ষ্য-৬’ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে এই প্ল্যান্ট।এসটিপি (2)

বুধবার (১২ জুলাই) এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা ওয়াসার প্রধান নির্বাহী বলেন, বৃহস্পতিবার দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই প্ল্যান্টে দৈনিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন পয়ঃশোধনপ্রক্রিয়ার ক্ষমতা আছে, যা রাজধানীর মোট পয়ঃশোধনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।

দেশকে একটি সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার আওতায় আনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘পথপ্রদর্শক’ উল্লেখ করেন তিনি। সেই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার শতভাগ পয়ঃশোধনের মহাপরিকল্পনা তুলে ধরে।

সে অনুযায়ী পাগলা, উত্তরা, রায়েরবাজার ও মিরপুর এলাকায় একটি করে আরও চারটি পয়ঃশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। পাগলা স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং রায়েরবাজারের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার প্রধান নির্বাহী বলেন, বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাকা ওয়াসা তাদের কার্যক্রমের ৭০ শতাংশ ডিজিটালাইজড করেছে। পদ্মা ও সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সম্পূর্ণ অটোমেটেড করা হয়েছে।দাশেরকান্দি এসটিপি (3)

তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের মহাসড়কে সরকারের যাত্রায় আমরা সঙ্গী। দাশেরকান্দি শোধনাগার প্ল্যান্ট, যা খিলগাঁও থানার অন্তর্গত, আফতাবনগর সংলগ্ন এবং গুলশান (একাংশ), বনানী, তেজগাঁও, নিকেতন, মগবাজার, মালিবাগ, আফতাবনগর, বাড্ডা, কলাবাগান, পান্থপথ, ধানমন্ডি (একাংশ) ও হাতিরঝিলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার পয়ঃশোধনের ব্যবস্থা করবে ওয়াসা।’

ওয়াসা জানায়, চীনের অর্থায়নে ৩ হাজার ৪৮২ দশমিক ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬২ দশমিক ২ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এই অর্থের ১ হাজার ১০৬ দশমিক ৪২ কোটি টাকা জিওবি তহবিল থেকে, ১০ কোটি টাকা ওয়াসার তহবিল থেকে ব্যয় হবে। এ ছাড়া চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। প্রকল্পটির বাকি ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে সহায়তা হিসেবে আসবে।

প্রকল্পটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫৬০ টন প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাসহ একটি স্লাজ ড্রাইং-বার্নিং সিস্টেম রয়েছে। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। পাওয়ার চায়নার অধীনে চেংডু ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের ডিজাইনে নির্মিত প্রকল্পটি এক বছরের অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়।দাশেরকান্দি এসটিপি (2)

ঢাকার চারপাশে নদীদূষণ রোধে পাঁচটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে ওয়াসার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্টটি নির্মিত হয়েছিল।

প্রকল্প অনুযায়ী, প্রগতি সরণিতে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে একটি বর্জ্য উত্তোলন স্টেশন, রামপুরা থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ট্রাঙ্ক স্যুয়ার লাইন এবং দশেরকান্দিতে মূল শোধনাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।

মহাপরিকল্পনার সুপারিশ অনুযায়ী, ঢাকার দক্ষিণাংশে পাগলা ক্যাডমেন্টের অন্তর্ভুক্ত এলাকার পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা ওয়াসার অধীনে বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবির অর্থায়নে ঢাকা স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের আগে ঢাকার একমাত্র পয়ঃশোধনাগার ছিল পাগলা পয়ঃশোধনাগার এবং এর আওতায় ঢাকার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশন সুবিধা প্রদান করা যেত। পয়ঃশোধনাগারটি ১৯৭৮ সালে নির্মিত হয় এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে ১৯৯১-৯২ সালে পুনঃসংস্কার করা হয়। প্রতিদিন ১২ কোটি লিটার শোধনক্ষমতাসম্পন্ন করা হয়েছে এটি।দাশেরকান্দি এসটিপি (1)দক্ষিণ ঢাকার নাগরিকদের আধুনিক ও নিরাপদ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা প্রদানের জন্য ঢাকা স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের (ডিএসআইপি) আওতায় পাগলা পয়ঃশোধনাগার আধুনিক ও বর্ধিতকরণসহ পাগলা ক্যাচমেন্টের প্রায় ৬৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধুনিক পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ বা পুনর্বাসন করা হবে।

Views: 2