বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য তার সরকারের দেওয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লুফে নিতে বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নসহ সমস্ত নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। খাতগুলো হচ্ছে, অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র, এবং বস্নু-ইকোনমি।

গত বছর দেশে এফডিআই প্রবাহ ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪৮ কোটি ডলার- যা এখন স্থানীয় মুদ্রায় ৩৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে)। দেশে ১৯৯০ সালের পর এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই। দেশে গত ৩৩ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের এফডিআই আসে। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআইপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় যেখানে এফডিআই প্রবাহ ১৬ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে ২০ শতাংশ বেড়েছে। সব এলডিসির পাওয়া মোট এফডিআইয়ের ৭০ শতাংশই পেয়েছে মাত্র ৫টি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। বাকি চার দেশ হলো ইথিওপিয়া, কম্বোডিয়া, সেনেগাল ও মোজাম্বিক। বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের সর্বশেষ বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০২৩ এ এই তথ্য উঠে এসেছে। দেশে ২০২০ সালে এফডিআই হ্রাসের পর ২০২১ সালে আবার বাড়ে- যা পরের বছরও বজায় থাকে। ২০২১ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ২৮৯ কোটি ডলার। অন্য বছরগুলোর মধ্যে দেশে ২০১৫ সালে ২২৩ কোটি ডলার, ২০১৬ সালে ২৩৩ কোটি ডলার, ২০১৭ সালে এসেছিল ২১৫ কোটি ডলার ও ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। দেশে ২০২২ সালে এফডিআই বাড়লেও সামগ্রিক এফডিআই স্টক বা মোট বিনিয়োগের স্থিতি কিন্তু কমেছে। এই বছর বিনিয়োগের স্থিতি কমে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে- যা ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার। এদিকে বাংলাদেশকে নন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করেছে আঙ্কটাড। মুডি’স ইনভেস্টর্স সার্ভিস গত মে মাসে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি রেটিং বি১ থেকে কমিয়ে বিএ৩ করার কারণেই মূলত আঙ্কটাড বাংলাদেশকে এই গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করে। আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সামগ্রিকভাবে এফডিআই প্রবাহ কমে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারে নেমে আসে, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। মূলত রাশিয়া-উইক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা, উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণের কারণে এফডিআই প্রবাহ কমেছে। সংস্থাটির মতে, উন্নত দেশগুলোতেই এফডিআই প্রবাহ সবচেয়ে কমেছে। এই দেশগুলোয় এফডিআই প্রবাহ ৩৭ শতাংশ কমে ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার হয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এফডিআই বেড়েছে ৪ শতাংশ। অবশ্য সব উন্নয়নশীল দেশ সমানভাবে তা পায়নি। আঙ্কটাড বলছে, গত বছরের তুলনায় গ্রিনফিল্ড বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই তা বেড়েছে। ইলেকট্রনিকস, সেমিকন্ডাক্টর, অটোমোবাইলসহ যেসব খাত সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতার কারণে ভুগছিল, সেগুলোতেই সবচেয়ে বেশি গ্রিনফিল্ড বা নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে সৌর ও বায়ুবিদু্যৎ খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও গতি কমেছে। যেমন ২০২১ সালে যেখানে এই দুই খাতে বিনিয়োগ বেড়েছিল ৫০ শতাংশ হারে- যা গত বছর কমে ৮ শতাংশে নেমেছে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা থেকে ঘাটতি ২০১৫ সালের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, এমন উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়ে সংস্থাটি টেকসই জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার কবলে পড়েছে। দেশে দেশে চাহিদা পড়ে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ২০২১ এর প্রথমার্ধে এফডিআই ১৯ শতাংশ কমে হয়েছিল ১১৬ কোটি ১৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তখন দক্ষিণ এশিয়ায় এফডিআই কমেছিল ৩১ শতাংশ বা ২ হাজার কোটি ডলার। এরপর বিশ্বজুড়ে করোনার ধাক্কায় বিভিন্ন দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আরো কমেছে, তা বলাই বাহুল্য। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে লকডাউন আরোপ করা হয়েছিল পরিস্থিতি বিবেচনায়। অর্থনীতিতে যার মারাত্মক পরিণতি অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠেছিল। ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন সবই স্থবির হয়ে পড়েছিল এর জেরে। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগ তো করেইনি, বরং বিদ্যমান বিনিয়োগও অনেক ক্ষেত্রে গুটিয়ে এনেছে বা সংকুচিত করেছে। আবার নতুন করে করোনার ঢেউ প্রকট হয়ে ওঠায় অনিশ্চয়তা ও গভীর মন্দার আশঙ্কায় অনেক নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে যায়। করোনার কারণে সারাবিশ্বে এফডিআইয়ের হার অর্ধেক হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ রয়েছে। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআইপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় সার্বিকভাবে এফডিআই বেড়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ভারত ৫ হাজার ৭৩৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে- যা আগের বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। পাকিস্তানে এফডিআই গেছে ২১৫ কোটি ডলার- যা আগের বছরের চেয়ে ৩৮ শতাংশ কম। শ্রীলঙ্কায় এফডিআই বেড়েছে; অন্যদিকে, নেপালে কমেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য তার সরকারের দেওয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লুফে নিতে বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নসহ সমস্ত নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। খাতগুলো হচ্ছে, অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র, এবং বস্নু-ইকোনমি।

\হ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন দফা নির্বাচনে জয়লাভের ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ-পরিশ্রমী জনসম্পদ সৃষ্টি, আকর্ষণীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উদার বিনিয়োগনীতি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারের মধ্যবর্তী ভৌগলিক অবস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থার ফলে ৬০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে। বাংলাদেশে অনেক সুযোগ আছে বিনিয়োগ করার। সম্ভাবনাও অনেক। গত চার বছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার চারগুণ বেড়েছে। এখানে শিক্ষিত, উদ্যমী, পরিশ্রমী জনশক্তি রয়েছে। লজিস্টিকস খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকেই অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। যেমন, বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয় কিংবা উপযুক্ত জমি পাওয়া যায় না। সরকার এর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এক দরজায় সেবা (ওএসএস) চালু করেছে। এগুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনো উদ্যোগই চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি। এর সঙ্গে ডলার-সংকট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি বিষফোড়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে। ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ফলে অনেক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও যতখানি বিনিয়োগ হওয়ার কথা সেটাও আসেনি। ডলার-সংকটের কারণেই বর্তমানের এই জ্বালানি-সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে। বর্তমানে জ্বালানি-সংকটে দেশীয় শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহী হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। দেশের করব্যবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগকারীর অনেক অভিযোগ রয়েছে। কয়েক দফায় কমানোর পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সার্বিক করের পরিমাণ অনেক বেশি। কর আরও কমানো দরকার। এ ছাড়া ভ্যাটের একাধিক হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি এই ব্যবস্থাকে আরও সহজ করা হলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর আসে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। তার মানে গত বছর ৫৫ কোটি ডলারের এফডিআই বেশি এসেছে। তবে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ কমেছে, বেড়েছে পুনর্বিনিয়োগ। ডলার-সংকটের কারণে অনেক কোম্পানি নিজ দেশে মুনাফা নিতে পারেনি। এ কারণে কাগজে-কলমে পুনর্বিনিয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের পুরোটা বিনিয়োগ হয়েছে, তা বলা যাবে না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিআই জিডিপির ৩-৪ শতাংশ করার কথা ছিল। জিডিপির ৩ শতাংশ ধরলেও প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই আসা উচিত ছিল। সেখানে আমাদের বর্তমান অবস্থান খুবই নগণ্য। সার্বিকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল ২৮ শতাংশ। তবে সেই জায়গায় পৌঁছানো যায়নি। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবার আগে রিটার্ন নিয়ে চিন্তা করেন। যখন তারা দেখেন পদ্ধতিগত কিছু সমস্যার কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ করতে চান না। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়েও জাপানিরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে তারা বলেছে, বাংলাদেশে ব্যবসায় সমস্যা আছে। সমস্যাগুলো দ্রম্নত সমাধান না করে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। জ্বালানি-সংকট ও পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বস্ত্র, তৈরি পোশাক, সিরামিক, ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানার উৎপাদন কমেছে। তার মধ্যে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকে নতুন নিয়োগ বন্ধ। কোনো কোনো কারখানা কর্মী ছাঁটাইও করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে। ফলে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় শতাংশ কম। সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক থেকে এসেছে। বর্তমানে এ খাতের প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৭৭ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসার পরিবেশ বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে নেই। জ্বালানি-সংকটের কারণে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলো ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে। নতুন নিয়োগ বন্ধ। ডলার-সংকটের কারণেই বর্তমানের এই জ্বালানি-সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। শিগগিরই ব্যাংকঋণের সুদেরহার দুই অঙ্কের ঘরে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বিনিয়োগ তো দূরে, যারা ব্যবসায় আছেন, তাঁদের টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সব দোষ যুদ্ধের ওপর চাপানোর সময়টা পার হয়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই অসুবিধায় পড়েনি। অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না। এ জন্য সমস্যার মূল কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্রম্নত সেগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধের ওপর দায় চাপানোর কৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, অধিক বিনিয়োগ মানে অধিক কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের পথে আরো এগিয়ে যাওয়া। অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থান। আমাদের ইমেজ সঙ্কট রয়েছে। এটাকে সামগ্রিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্রান্ড ভ্যালু অনেক কম। ইনভেস্টররা বাংলাদেশের কথা শুনলে মনে করে এই দেশ অনেক গরিব কিংবা দুর্যোগকবলিত দেশ। এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। প্রয়োজনে গেস্নাবাল পিআর এজেন্সি নিয়োগ করে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। আমরা গরিব দেশ নই, উন্নয়নশীল ও বিনিয়োগবান্ধব- এটা সবাইকে বোঝাতে হবে। সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কীভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা। দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হয়েছে। এখন কীভাবে এক দরজায় সব সেবা দিয়ে বিদেশিদের সেখানে আকর্ষণ করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: রেজাউল করিম খোকন, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক