সুনীল অর্থনীতির বিকাশ : সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ

সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি পরিভাষাটি অর্থনীতিতে নতুন খাত হিসেবে নামকরণ হলেও এটি একটি আদিম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সাগর মহাসাগরে চলাচল ও পরিবহন মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে জড়িত। সাগরে মাছ ধরা এবং সাগর পাড়ি দিয়ে দেশ দেশান্তর গমনাগমন কোনো নতুন বিষয় নয়। এর সাথে খনিজ আহরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পর্যটন ইত্যাদি যুক্ত হয়ে ব্লু ইকোনমি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সেক্টরে পরিণত হয়েছে বিভিন্ন দেশে এবং আরো হচ্ছে।

ব্লু ইকোনমির আধুনিক সংজ্ঞানুসারে, সাগর মহাসাগরের উপরিভাগের এবং অভ্যন্তরীণভাগের এবং সমুদ্রতলদেশের সকল সম্পদের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে যে অর্থনীতির খাত গড়ে ওঠে, তাই ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি। সমুদ্র পরিবহন, সামুদ্রিক বায়োডাইভার্সিটি সংরক্ষণ এবং সমুদ্রের যত রকমের টেকসই ব্যবহার সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানে ১৪৩(১)(খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্ভুক্ত মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন।

তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (আনক্লস) অনুসমর্থন করেন। ফলে বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার লাভের সুযোগ হয়। আমরা মিয়ানমার ও ভারতের দাবির বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করতে সক্ষম হই। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে।

বর্তমানে সাতটি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো একক ও যৌথভাবে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত আছে। সুনীল অর্থনীতিতে জ্বালানি, সমুদ্র ও নৌপরিবহন, বন্দর সুবিধা, মৎস্য পর্যটন এবং বায়োটেকনোলজি খাতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের সুপরিচিত সমুদ্রজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা একটি বিশাল সমুদ্রসীমার ন্যায্য অধিকার লাভ করার পর সরকার ব্লু ইকোনমিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে একটি ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবকে প্রধান করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ব্লু ইকোনমির কার্যক্রম মনিটর করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলছেন, ব্লু ইকোনমির চারটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করলে বছরে বাংলাদেশের পক্ষে ২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। এই চারটি সেক্টর হলো তেল ও গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য আহরণ, বন্দর সম্প্রসারণ এবং পর্যটন। এই খাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

বাংলাদেশ বর্তমানে উপকুল থেকে মাত্র ৩৫-৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মৎস্য আহরণ করে থাকে। কিন্তু ২০০ নটিক্যাল মাইলব্যাপী আমাদের অর্থনৈতিক জোন। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড এবং চীনের মধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য আহরণে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। গত ১০ বছরে দেশে মাছের উত্পাদন ৫৩% বেড়েছে এবং মাছ রপ্তানি বাবদ আয় বেড়েছে এই সময়ে ২০%। মৎস্য সংগ্রহে আমাদের সমুদ্র এলাকা দেশের মৎস্যশিল্পকে নিশ্চিতভাবে ব্যাপক বিকশিত করতে পারে।

আমাদের সমুদ্রতলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা অন্য দেশের উপসাগর বা সাগরের চেয়ে অনেক বেশি বলে আন্তর্জাতিক সমুদ্র ও জ্বালানি গবেষকগণ মনে করেন। জিরকন, রিউটাইল, সিলিমানাইট, লাইকক্সিন, ইলমেনাইট, গার্নেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট ইত্যাদির আকর আছে বলে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করেন। মোনাজাইট হলো রেডিও অ্যাক্টিভ একটি পদার্থ যা নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরে ব্যবহৃত হয়।

বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ১৩টি স্থানে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম সমৃদ্ধ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে যার মূল্য স্বর্ণের চেয়ে দামি। সমুদ্রজয়ের ফলে বাংলাদেশে ভারত থেকে ৮টি গ্যাস ব্লক এবং মিয়ানমার থেকে ১৩টি গ্যাস ব্লকের মালিকানা লাভ করেছে, যা থেকে ভবিষ্যতে ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে।

আমাদের রয়েছে সমুদ্র পর্যটন বা মেরিন ট্যুরিজমের বড় সুযোগ। সামুদ্রিক ঘাস, শেওলা ইত্যাদি চাষ করে অর্থ উপার্জন করা যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সামুদ্রিক শেওলা, যেটাকে সেন্ট মার্টিনের লোকেরা বলে হ্যাজলা, সংগ্রহ করে ইনফর্মালি মিয়ানমারের জেলেদের কাছে বিক্রি করে থাকে। এই হ্যাজলা দিয়ে নাকি মিয়ানমারের নাগরিকগণ নেশাজাতীয় এবং ওষুধ তৈরি করে থাকে। বিষয়টি সেন্ট মার্টিনের জেলেদের কাছে কথা বলে এই নিবন্ধের লেখক জানতে পেরেছেন।

মোটকথা, মোট জাতীয় উত্পাদন বা জিডিপিতে সুনীল অর্থনীতি রাখতে পারে ঈর্ষণীয় অবদান। দেশের সমুদ্রপথে শতকরা ৮০% পণ্যের আমদানি রপ্তানি হয়। তন্মধ্যে, শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৭০% আমদানি রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর আধুনিকায়নে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বদ্ধপরিকর।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমুদ্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার। বাংলাদেশও তার অফশোর এবং অনশোরে বিদ্যুৎ উত্পাদনের পরিকল্পনা করছে, যা হবে ক্লিন ও গ্রিন এনার্জি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্লু ইকোনমির ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তার নির্দেশনায় প্রধানমন্ত্রীর এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা জাতিসংঘ ঘোষিত সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

প্রণয়ন করা হয়েছে শতবর্ষী উন্নয়ন পরিকল্পনা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ (ডেল্টা প্লান ২১০০)। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে দেশের টেকসই উন্নয়ের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে হবে একটি উন্নত দেশ এবং ২১০০ সালে হবে এদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লেখক: শরীফ শেখ
লেখক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী

Views: 13