
একাত্তরের বিজয়ের পরে, বিপর্যয়টা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ৪৪তম বিজয় উৎসব ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ’ পেঁৗছাতে অনেক বিপর্যয়কর ও কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার তিন প্রভাবশালী রাজনীতিক- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো তিনজনই হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। পরের প্রজন্মে যারা এসেছিলেন রাজনীতিতে, রাজীব গান্ধী এবং বেনজীর ভুট্টোও একই ভাবে হত্যাকা-ের শিকার হন। একুশে আগস্ট বেঁচে গিয়ে অঙ্কটা পাল্টে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো মানদ-ের বিচারে শেখ হাসিনা, দেশের এবং দেশের বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য আশীর্বাদ। অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা হচ্ছে, এই আশীর্বাদ থেকেও বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতা হত্যা চিরতরে বন্ধ করে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের এদেশীয় এজেন্ট তৎকালীন অবৈধ সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। স্বদেশে ফিরে আসার পরেও তারা বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে প্রবেশ করতে দেয় নাই। রাস্তায় মিলাদ পড়তে হয়েছে। এমনকি ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন সফল হওয়ার পরেও বিপর্যয়কর পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন প্রচেষ্টা মহলবিশেষ অব্যাহত রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই দানবীয় শক্তি স্বয়ং দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করেছিল। তাদের এই অপচেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে! এজন্য দেশপ্রেমিক সব জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখার স্বার্থে দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এভাবে বিধ্বস্ত বিপর্যয়ের ঢেউ এখনো আছড়ে পড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল মোট প্রায় আটাশ বছর পর্যন্ত এ দেশে চলেছে বিপর্যয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তথা নির্যাতন-নিপীড়নের লক্ষ্য ছিল এ দেশ থেকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আদর্শকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দেয়া। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির উপরে এসময়ে নেমে এসেছে নির্যাতন নিপীড়নের স্টিম রোলার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির পাশাপাশি, বিপর্যয়কর প্রক্রিয়ার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী।
১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে যারা স্মরণার্থী হিসেবে ভারতে বসবাস করছিল তাদের ফিরিয়ে এনেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় পর্যন্ত তখন সম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু রায় বাস্তবায়ন হতে পারেনি। তার আগেই ২০০১-এর নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামায়াত-বিএনপি জোট সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী হত্যা নির্যাতনের তা-বলীলা শুরু করে । এই সময়েই ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে নেত্রীকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৭ আগস্ট সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী বোমা হামলা করা হয়েছিল। দশ ট্রাক অস্ত্র তখনই ধরা পড়েছিল। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধীতাকারী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিল আর তার বিধবা পত্নী বেগম খালেদা জিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যেসব কাজ করেছে তার ফলে এ দেশ থেকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছে এবং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও দোষীদের শাস্তি হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আদালতের রায় অনুযায়ী কাদের মোল্লা, সাকা চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এই ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের মধ্যেই দেশরত্ন শেখ হাসিনার সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র সংহতকরণ প্রভৃতিতে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসী এখন প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি নিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি এখন খাদ্যশস্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির আকার বেড়েছে। এই সঙ্গে বেড়েছে বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি, কর্মসংস্থান প্রভৃতি। মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। এই আকার বেড়ে এখন আট লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম। আর ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্ব ৩৩তম। আগামীতে এ দেশের অর্থনীতি আরও এগোবে বলে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে।
সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার। আর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১২৯ ডলার। উলি্লখিত হিসাব অনুযায়ী, গত ৪৩ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় প্রায় ১১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তার আকৃতি ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। আর দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩০ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সিংহভাগই ছিল গরিব। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক মানুষ দরিদ্র। জনসংখ্যার হিসাবে এই হার বেড়েছে। তবে অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা কমে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন বছরে পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি থাকায় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৪৭ শতাংশ। পরে তা কমতে শুরু করে। এখন তা নেমে সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশের ঘরে অবস্থান করছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির উন্নতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের উন্নতি করেছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার জটিল সমস্যা আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী মীমাংসা হয়েছে এবং বাংলাদেশ বিপুল আয়তনের সমুদ্রসীমার মালিকানা পেয়েছে। ভারতের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে অভাবনীয় উন্নতি করার কারণে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক সম্মানজনক পুরুস্কার লাভ করেছেন। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘পলিসি লিডারশিপে’ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারের কথা উল্লেখ করা সমীচীন। এসময় তিনি আইসিটি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারটি গ্রহণের পরে প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় মার্কিন কংগ্রেস উইম্যান ইভেট ডায়ান ক্লার্ক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন তা একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের জন্য বাস্তবভিত্তিক এবং সবচেয়ে বড় অর্জন। ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, রোববার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের আইনসভার সদস্যা, মার্কিন কংগ্রেসের পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি, জনস্বাস্থ্য এবং বাণিজ্যবিষয়ক কমিটির প্রভাবশালী এই নেতা বলেন, ‘শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশিদের গর্ব নয়, তিনি আমাদেরও গর্ব। তিনি সকলের সেরা।’ ক্লার্ক আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অবশ্যই আপনাদের (বাংলাদেশিদের) সমর্থন থাকা উচিত।’ ক্লার্ক বলেন, ‘শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি ও কর্মসূচির জন্যই এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।’
পেট্রল বোমা হামলা ও অন্যান্য নস্যাৎমূলক তৎপরতা চলা সত্ত্বেও জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মকুশলতার কারণে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ’, ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্য’ প্রভৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে একটি উন্নত বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয় । দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ‘নিম্ন মধ্যম আয়ের’ দেশ থেকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের দিকে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলছে।
অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়