ওষুধ রপ্তানির বাজার বাড়ছে

ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দিন দিন আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর অভ্যন্ত্মরীণ চাহিদার ৭০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি হলেও এখন চিত্র পুরোপুরি উল্টো। দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ মিটিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুত ওধুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবছর রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন দেশ যোগ হচ্ছে তালিকায়।
উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডসসহ প্রায় ১৩০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি চলছে। এছাড়া সম্প্রতি তুরস্ক, কুয়েত, শ্রীলঙ্কা, বেলারম্নশ, দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানির জন্য চুক্তি করেছে। লাইসেন্সিং চুক্তি করে বাংলাদেশের কারখানায় উৎপাদন করে ওষুধ নিতে চান জাপানি উদ্যোক্তারাও।

ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ওষুধ রপ্তানি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পোশাক খাতের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। কেননা বিশ্বে এর বাজার ব্যাপক বিস্ত্মৃত। তাই বর্তমান বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন বাজার ধরতে মনোযোগ দিচ্ছে সবাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই রপ্তানিতে ধারাবাহিকভাবে উলেস্নখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন শুরম্ন করেছে। মুন্সীগঞ্জের এপিআই পার্ক পূর্ণাঙ্গ চালু হলে ওষুধশিল্পের কাঁচামালের জন্য আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না এবং দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হতেও সময় লাগবে না।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোও (ইপিবি) ওষুধ রপ্তানি খাতটিকে ইতিমধ্যে দারম্নণ সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৫০ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার বা ৪০৩ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৬৬ শতাংশ এবং নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫.৬৪ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে খাতটি থেকে মোট রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
ইপিবির পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরেই ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১১-১২ অর্থবছরে খাতটি থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৮.২৫ মিলিয়ন ডলার এবং সমাপ্ত অর্থবছরে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৮৯.১৭ মিলিয়ন ডলারে। সে হিসেবে পাঁচ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ৪১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এ সময় খাতটি কম-বেশি হলেও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৩.৯৮ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৫.৭৫ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪.৯১ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৩.০৪ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮.৬০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, স্বল্প মূলধন ও ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখায় বিদেশি বাজারে বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ওষুধের দাম অনেক কম। আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বের ওষুধবাণিজ্যের ১০ শতাংশ দখল করা সম্ভব। এতে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। একই সঙ্গে এ খাতে ২ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অনেক কোম্পানিই এখন আন্ত্মর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করছে। একই সঙ্গে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সার্টিফিকেশন সনদও পেয়েছে বেশ কিছু কোম্পানি। এ কারণে ওইসব দেশসহ অন্য দেশে ওষুধ রপ্তানি পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। তারা বলছেন, দেশের ওষুধশিল্প সবদিক দিয়ে পরিপক্বতা অর্জন করেছে। মান বেড়েছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণও উন্নত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, বিশ্বে ওষুধের রপ্তানি বাজার ১৭০ বিলিয়ন ডলারের। এর ১০ শতাংশ ধরা গেলে রপ্তানি আয় ১৭ বিলিয়ন ডলার হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে বিশ্বমানের ওষুধ পরীক্ষাগারের কাজ চলছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে। এসব কাজ শেষ হলে এ শিল্পের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে।
জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পাবনা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১ হাজার ৩৩৮টি ছোট-বড় ওষুধ উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। বিশেষ করে বেক্সিমকো, স্কয়ার, গস্নাক্সো, রেনেটা, ইনসেপ্টা, হেলথ কেয়ার, এসকেএফ, সেনডোজসহ বেশ কিছু কারখানায় আন্ত্মর্জাতিকমানের ওষুধ উৎপাদিত হয়। দেশের উন্নতমানের ৫৪টির বেশি কোম্পানি ৩০৩টি গ্রম্নপের ওষুধ রপ্তানি করে।
জানা যায়, ২৭৮টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্র্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ১৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করে। এ ছাড়া দেশের ২৬৬ ইউনানি, ২০৫ আয়ুর্বেদিক, ৭৯ হোমিওপ্যাথিক ও ৩২টি হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করে।