তামা, কাঁসার অলঙ্কার রপ্তানি: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

তামা, পিতল আর কাঁসা দিয়ে এসব গহনা তৈরি হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চমূল্যের কারণে এসব গহনাই এখন বেশি চলছে। বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা এসব গহনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ভাকুর্তার কারখানাগুলোয় হাজারো নকশার গহনা পাওয়া যায়। চাইলে নিজের পছন্দমতো ডিজাইন দিয়েও গহনা তৈরি করানো যায়।

দেশের রপ্তানি ভা-ারে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু পণ্য বিশ্ববাসির নজর কাড়ায়, বিশ্ববাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করায় বাড়ছে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা। এটি দেশের মানুষের জন্য, অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়েই তৈরি করছে রুপা, তামা, কাঁসা, পিতলের গহনা। সেই গহনা আবার বিদেশের বাজারে রপ্তানির জন্যই তৈরি হচ্ছে। এটি সুখবর। সাভারের হেমায়েতপুরের এরকম একটি গ্রাম। যেখানে অসহায়, হতাশ, কর্মহীন মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছে। পাশাপাশি কর্মস্থান ও অর্থ রুজির পথ সুগম করে দিয়েছে। এই গ্রামে অবস্থিত একটি প্রকা- বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে বাজারের মাঝখানে। বটগাছ ঘেঁষে সারি সারি গহনা তৈরির দোকান। আছে গহনা তৈরির কাঁচামাল বিক্রির দোকানও। এমনই একটি দোকানের মালিক ও কারিগর মাধব মিত্র বললেন, এই গ্রামের সবার পেশা গহনা গড়া। এদের কেউ গহনার কাঁচামাল জোগান দেন, কেউবা ডাইস বানানোর কাজ করেন। আবার কেউ গহনাগুলো জিঙ্কে দস্তা ধুয়ে রং বের করেন। দোকানিরা কাঁচামাল পৌঁছে দেন গ্রামের ঘরে ঘরে।
এরপর সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে অলঙ্কার তৈরির কাজ। বাজার থেকে বের হয়ে গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল তার প্রমাণ। প্রত্যেক ঘরের দাওয়া, দরজা, ঘরের ভেতরজুড়ে অলঙ্কার তৈরির সরঞ্জামের ছড়াছড়ি। ছেলে-বুড়ো, মা-মেয়ে-বউ সবাই ব্যস্ত গলার হার, কানের দুল, ঝুমকা, চেন, পায়েল, নূপুর তৈরিতে। এ দৃশ্য সাভারের হেমায়েতপুরের ভাকুর্তা গ্রামের। রাজধানীর লাগোয়া বুড়িগঙ্গার তীরের গ্রামীণ জনপদ ভাকুর্তা। সাভার উপজেলার ইউনিয়ন এটি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার পেরোলেই তুরাগ নদের ওপর ছোট্ট একটি লোহার সেতু। সেখান থেকে ভাকুর্তা মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এই ইউনিয়নভুক্ত গ্রামের সংখ্যা ৩৬। এই জনপদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গহনা শিল্প। গ্রামগুলোর মধ্যে চুনারচর, ডোমরাকান্দা, সোলারমার্কেট, খাগুড়িয়া, নলাগুড়িয়া, মোগরাকান্দা, চাপরা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, বাহেরচর, মুশরিখোলা, ঝাউচর, লুটেরচর, চরতুলাতলি, চাইরা সর্বত্র অলঙ্কার তৈরির একই দৃশ্য। গ্রামের মানুষ কৃষি কাজ ছাড়াও অলঙ্কার তৈরির কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। গেরস্ত বাড়ির পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অলঙ্কার তৈরির কাজে নিয়োজিত। ঘর এখানকার মহিলারা সংসার সামলানোর পাশাপাশি তারা গহনা তৈরি করে পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন। অবসরে গহনার কাজ করে ছেলেমেয়েরা নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেরা বহন করতে পারে। এ কাজ করে ভাকুর্তার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। তাদের কারও কারও অধীনে ৫-৭ কর্মচারী কাজ করেন। ব্যবসার সফলতায় কেউ কেউ জমি কিনে পাকা বাড়িও নির্মাণ করেছেন। এক সময় গ্রামাঞ্চলে মহিলারা এসব গহনা ব্যবহার করতেন, মাঝে বিলুপ্ত ছিল এর ব্যবহার। এখন আবার নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক সময় স্বর্ণের পরিবর্তে ইমিটেশন গহনা, রুপা, তামা, কাঁসা, পিতলের গহনা ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছেন। এটি সুখবর।

এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জের মরমি কবি ও গবেষক ইবনে সালেহ মুনতাসির রচিত ‘নিয়ামত পুরী বাংলা’ লিরিকটি প্রাসঙ্গিক। লিরিকটি হচ্ছে : ‘যে যায় লংকায় সেই হয় রাবন/ নিয়ামতপুরি বাংলায় সবাই হয় পবন/ লংকার জল বায়ু লংকার ভস্মের কারণ/বাংলার জলবায়ু বাংলায় যেতে বারন/ সভ্যতা মানুষেরই সৃষ্টি সভ্যতার আছে কারণ/ সভ্যতার বিকাশ ঘটে সভ্যতার আছে বিশেষণ/ গণতন্ত্র স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিয়মনীতির যে নিঃসরণ/ আলোকিত সমাজ রাষ্ট্র বিনির্মাণে আইনের প্রয়োজন…উন্নয়নের সংস্কার আধুনিকায়নের হাওয়া লেগেছে আজ/ দিন বদলের পালায় যুগ পরিবর্তনের হাওয়ায় লগন লেগেছে আজ/ সারাদেশে আজ পরিবর্তন আর সংস্কারের শুধু কারুকাজ/ ভাগ্যেও চাকা ঘুরছে জোরে চাকা ঘুরাতে হবে আরও জোরে/..” শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, এই পেশার সঙ্গে যুক্ত দেশের অন্য জেলার বাসিন্দারাও। তারাও নিরলস কাজ করছেন এখানে। ভাকুর্তা ইউনিয়নের অধিকাংশ পরিবারেরই কমপক্ষে একজন করে হলেও এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর এই পণ্যগুলো আরও চকচকে ও আকর্ষণীয় করে বাজারজাত করা হয়। ঢাকার নিউ মার্কেট, আজিজ সুপার, চাঁদনীচক মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সব বড় বড় শপিং মলের গহনা আসে ভাকুর্তা থেকে। মার্কেটগুলোয় সিটি গোল্ড বা এন্টিক নামে এসব গহনা বিক্রি হয়। শুধু দেশে নয়, এখানকার গহনার চাহিদা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও। দেশের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি এসব গহনা রপ্তানি করা হচ্ছে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এই শিল্পের আরও প্রসার ঘটলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দেশের অর্থনীতিতে। এমন ধারণা অনেকের। অন্য পেশার চেয়ে তুলনামূলক আয় বেশি। তাই কারিগর, ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমিক সবার কাছেই সমাদৃত এই কাজ। এক সময় অবহেলিত জনপদ ছিল ভাকুর্তা। শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। বেকার, জীবনযাপন ছিল বেশির ভাগ মানুষের। এই জনপদে আজ আর কেউ বেকার নেই।
এখানে তৈরি করা গহনার অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি হয় ভারত থেকে। এরপর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার থেকে সেগুলো কিনে নেন ভাকুর্তার ব্যবসায়ীরা। দেশেই কাঁচামাল তৈরি হলে এই ব্যবসা থেকে সম্ভব বড় অঙ্কের রপ্তানি আয়। তবে এই বাজারে যেটি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ধাপ পেরিয়ে সাধারণ ক্রেতা পর্যন্ত আসতে আসতে সেটির মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১০০০-১২০০ টাকা। অলঙ্কারের বাজারে এক সময় বেশিই প্রচলন ছিল সোনা ও রুপার গহনার। কিন্তু গত এক দশকে এই অবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। এখন তামা ও পিতলের গহনার বিক্রিই বেশি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, গত তিন চার দশকে এটি দিন দিন জমে উঠেছে গহনার বাজার ঘিরে। রুপা ও তামাসহ ধাতব দ্রব্যের মিশেলে তৈরি হয় নান্দনিক এসব গহনা। কারিগরের নিপুণ হাতে দৃষ্টিনন্দন নকশা আর আকৃতিতে এসব গহনা তৈরি করেন। গহনা তৈরির উপাদান হিসেবে ভাকুর্তার কারিগররা বেছে নিয়েছেন রুপা, তামাসহ অপেক্ষাকৃত কম খরচের উপাদান। ধাতব পদার্থ থেকে মেশিনের সাহায্যে ছোট ছোট আকৃতিতে নকশা করে কেটে নেয়া হয়। নকশা আর উপাদানসামগ্রী যায় কারিগরের কাছে। গহনা তৈরির কাজটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে করতে হয়। অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ ঘটিয়ে তা নান্দনিক গহনায় রূপ দেন কারিগর।
একাধিক মালিক ও কারিগররা জানিয়েছেন_
তামা, পিতল আর কাঁসা দিয়ে এসব গহনা তৈরি হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চমূল্যের কারণে এসব গহনাই এখন বেশি চলছে। বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা এসব গহনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ভাকুর্তার কারখানাগুলোয় হাজারো নকশার গহনা পাওয়া যায়। চাইলে নিজের পছন্দমতো ডিজাইন দিয়েও গহনা তৈরি করানো যায়।
যেসব গহনা বেশি বিক্রি হয় তার মধ্যে কানের দুল, গলার চেন, হাতের বালা, ঝুমকা, নেকলেস, সীতাহার, চুলের ব্যান্ড, ক্লিপ, আংটি অন্যতম। দিনে দিনে এসব গহনার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি ভাকুর্তায় নারী সদস্যরাও সমান তালে অলঙ্কার তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্বামীকে গহনা তৈরির কাজে সাহায্য করে। এমনকি ছেলেমেয়েরাও স্কুল থেকে ফিরে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পায় গহনা তৈরির কাজ করে। ফলে নিজেদের লেখাপড়ার খরচ নিজেরাই বহন করতে পারে। মহাজন আমাদের কাছে অর্ডার অনুযায়ী রুপা প্রদান করে এবং কারিগররা সে রুপা দিয়ে গহনা তৈরি করে আবার মহাজনকে প্রদান করে। বিনিময়ে প্রতি ভরি রুপার গহনা তৈরি করে কারিগররা পায় ৩৩ টাকা। একজন কারিগর দিনে ১০-১২ ভরি রুপার গহনা তৈরির কাজ করতে পারে। এতে প্রতি শ্রমিকের মাসিক আয় হয় ১০-১২ হাজার টাকা।
রুপার চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন তামার ধাতু ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার গহনা তৈরি করা হয়। এ থেকে প্রতি মাসে একজন কারিগর আয় করেন ১০-১২ হাজার টাকা। মহাজনের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে গহনা তৈরি করে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করি। এজন্য প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। আমার স্ত্রী-সন্তানরাও আমাকে সাহায্য করে। শীতকাল ও ঈদের সময় অর্ডার বেশি হয়, তখন দিনরাত কাজ করতে হয়। গহনার ডিজাইনভেদে মজুরির পার্থক্য হয়ে থাকে। যেটার কাজ কম সেটার মজুরি ৪০-৪৫ টাকা আর যেটার কাজ বেশি সেটার মজুরি প্রতি ভরি ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত। বাড়িতে বসে পায়েল ও নূপুর তৈরি করি। কারণ এটার চাহিদা অনেক বেশি। পরিবারের সবাই খেয়েপরে সুখে আছি। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সোনার দাম। বর্তমানে ২২ ক্যারেট সোনার মূল্য প্রতি ভরি ৪৭০০০ টাকা, ২১ ক্যারেট প্রতি ভরি ৪৪৯৬৪ এবং ১৮ ক্যারেট প্রতি ভরি ৩৯৪৮২ টাকা। সাধারণ মানুষ সোনা কিনতে গিয়ে অনেকটাই নিরাশ হচ্ছেন। তাছাড়া সোনার তৈরি গহনা পরে বাইরে চলাফেরা করতে অনেকেই নিরাপদবোধ করেন না।
রাজধানীর জুয়েলারি দোকানগুলোয় ভাকুর্তায় তৈরি অলঙ্কারের চাহিদা স্বর্ণের চেয়েও বেশি। দফায় দফায় স্বর্ণের দাম বাড়ায় ব্যবসায় মন্দা চলছে। তার ওপর ৫% ভ্যাট দিতে হয়। যার ফলে স্বর্ণে লাভ খুবই কম। এ কারণে রুপা, তামা ও পিতলের অলঙ্কার বিক্রি করছি। মানুষ এসব অলঙ্কার বেশি কিনছে। সাধ থাকলেও সাধ্যের মধ্যে না থাকায় সোনার গহনা এখন আর কেনা হয় না। আগের যেসব স্বর্ণের অলঙ্কার ছিল সেগুলোর কিছু বিক্রি করে দিয়েছি আবার কিছু চুরি হয়ে গেছে। তাই সিটি গোল্ড মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের একমাত্র ভরসা। এগুলোর দামও যেমন কম আবার সৌন্দর্যও সোনার মতো। ভাকুর্তা ঘিরে গহনার ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠলেও পেশার সঙ্গে যুক্ত লোকজন জানালেন কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা। অন্য অনেক খাতে ঋণ পাওয়া গেলেও গহনা তৈরির জন্য কোনো ব্যাংক বা এনজিও প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয় না। এর ফলে গহনা তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত কম আয়ের মানুষ তাদের ব্যবসার আকার বাড়াতে পারছেন না। তাছাড়া রাজধানীর লাগোয়া হলেও ভাকুর্তার যোগাযোগ অবস্থা ভয়াবহ রকম খারাপ। ইউনিয়নের প্রধান সড়কটির স্থানে স্থানে গর্ত। এ এলাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে রাস্তাঘাট দ্রুত মেরামত, গ্যাস বিদ্যুৎসহ সবরকম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে এসব পণ্যের কাঁচামাল ক্রয়ে রপ্তানিতে নগদ সহায়তা, বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ দরকার আশা করছি শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারি মহল বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন দ্রুত। কারণ এসব সমস্যা সমাধান হলে উপকার হবে দেশের অর্থনীতির, দেশের মানুষের।