স্বাধীনতার ৫২ বছরে ক্রীড়াক্ষেত্রের সাফল্যগুলো

স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছর পূর্তি হয়ে ৫৩-তে পদার্পণ করলো। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র। সকল উন্নয়নের সঙ্গে এই দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রও এই ৫২ বছরে এগিয়ে গেছে। যোগ হয়েছে অনেক সাফল্যের পালক। বর্তমান থেকে হয়েছে ভবিষ্যতের সূচনা।

বাংলাদেশের খেলাধুলা নিয়ে একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৮৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে নিয়াজ মোরশেদ দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার বিরল সম্মানের অধিকারী হন। স্বাধীনতার ১৬ বছর পর দাবায় সেই বিস্ময়কর সাফল্য বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে ক্রিকেট। ১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপে খেলার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। এই সময়ে দলীয় অর্জনের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া আর যুবাদের বিশ্বজয় অন্যতম।

এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে শুটিং, দাবা, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, গলফ, আর্চারি থেকে এসেছে সাফল্য। তবে যা একটু স্বস্তির পরশ হয়ে এসেছে ক্রিকেট মাঠের সাফল্য। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি গোটা বাংলাদেশকে গেঁথেছিল এক সুতোয়। লাল-সবুজের দেশ একজোট হয়ে সামিল হয়েছিল বাধভাঙ্গা আনন্দ মিছিলে।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। ফুটবল পায়ে মুক্তিযুদ্ধে এক হয়েছিলেন ৩১ মুক্তিযোদ্ধা। ফুটবল দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই ও বিহারে ১৪টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বাধীন একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ও একমাত্র ফুটবল দল এই বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন তারই প্রমাণ দেয়। ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরুর পর বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সদস্য পদ বাংলাদেশ পায় ১৯৭৪ সালে, স্বাধীনতার তিন বছর পর। এরপর বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অংশ নিয়েছে ১৯৮৫ সালে। সেরা প্রাপ্তি অবশ্য এসেছে আরও চার বছর পর ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপে বাংলাদেশের লাল দলের জয়ের মাধ্যমে।

বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি এনে দিয়েছে ক্রিকেট। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্য পদ পায়। এর ঠিক ২০ বছর পর পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ পায় ১৯৯৭ সালে। সেবার কেনিয়া, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ডকে পেছনে ফেলে ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় করে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলে টাইগাররা। তবে প্রথম বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয়ার পরও বলা যায় খুব বেশি এগুতে পারেনি। তবে ২০০৭ সালে সেরা আটে জায়গা করাও বড় সাফল্যের মধ্যে পড়ে। এরপর ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিল লাল সবুজ প্রতিনিধিরা।

মেয়েরা ২০১৮ সালে এশীয় নারী ক্রিকেটের প্রথম শিরোপা জিতেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই মূল পুরুষ জাতীয় দলের। সর্বোচ্চ সাফল্য বলতে ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। ভারতের সঙ্গে সেই সেমির যুদ্ধে পরাজয়ে ভাঙ্গে ফাইনাল খেলার স্বপ্ন। এর আগে ও পরে মোট ছয়বার বিশ্বকাপ খেললেও একবারের জন্য শেষ চারে পৌঁছাতে পারেনি। ২০১২, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠলেও এশিয়ার সেরা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি ছেলেদেরে। প্রথমবার পাকিস্তানের কাছে আর পরের দুইবার ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এখানেই মেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে ছেলেরা। তবুও খেলাধুলায় যতটুকু পরিচিত তার বেশিরভাগই এসেছে এই ক্রিকেটের সৌজন্যে।

জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসাব করলে ফুটবল-ক্রিকেটের পরই রয়েছে হকি। বাংলাদেশ বোধকরি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যে দেশে ফুটবল-ক্রিকেট আর হকি প্রায় সমান জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু, হকি আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

এ যেন অবিশ্বাস্য এক অর্জন আসে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। এরপর বাংলাদেশ আরো চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছেন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন নিয়াজ। যে সময় বিশ্ব দাবা সংস্থা (ফিদে) তাকে মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টারের মর্যাদা দেয়, সে সময় এশিয়ার ৫ম গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন তিনি।

জাতীয় দলের চেয়ে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলগুলো সবসময়ই সমীহ জাগানিয়া। তার বড় প্রমাণ রাখে অনূর্ধ্ব-১৯ দল। ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি পঠিত কথা ছিল, উনিশের হাত ধরে বিশ্বজয়। যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। এটি যে কোনো স্তরের ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিশ্বকাপ জয়। ১৯৯৭ সালের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ট্রফি জয়ের ঘটনাও ছিল এটি।

ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার খুব কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর ২৬ জুন, ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। আর ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম টেস্ট জেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

টেস্ট ক্রিকেটে ছোট ছোট অর্জনের মধ্যেও বুক চিতিয়ে বলার মতো অর্জন মোহাম্মদ আশরাফুলের। অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রান ছাপিয়ে গেছে এই লিটল মাস্টার অভিষেক টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরি করেন। এ নন্দিত উইলোবাজের পর ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো শতকটি গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ জেতানো ইনিংস হিসেবে পরিগণিত।

সাকিব মানেই দর্শকদের মধ্যে আলাদা একটি উত্তেজনা, যা এখনো চলমান। আইসিসি রেকিংয়ে একটানা প্রায় ১০ বছর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমাধারী এই বাঁহাতি। এছাড়া ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টেরও যোগ্য দাবিদার ছিলেন সাকিব। বিশ্বকাপে ৬০৫ রান করার পাশাপাশি ১১ উইকেট শিকারীও সাকিব। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন অলরাউন্ড কৃতিত্ব আর কারো নেই।

অবহেলিত হলেও সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় টাইগ্রেসদের। এরপর একটু একটু করে ধীরলয়ে এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ৯ উইকেটে হারিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিকের মর্যাদা পায় দল। তবে সেরা সাফল্যটি এসেছিল ২০১৮ সালে। সেবার এশিয়া কাপ শিরোপা জেতে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে অনন্য উচ্চতায় পা রাখে মেয়েরা।

একটি সময় দেশের এক নাম্বার খেলা হলেও এখন আর সেই অবস্থা নেই। তারপরও আছে কিছু সাফল্য। ১৯৯৫ সালের মিয়ানমারে চার জাতি চ্যালেঞ্জ কাপে ট্রফি জয়। নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৯৯৯ সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে ফুটবলে প্রথম সোনা পায় ফুটবল দল। ২০০৩ সালে জয় করে সাফ ফুটবলের শিরোপা। ২০১০ সালে এসএ গেমস ফুটবলেও স্বর্ণ জেতে বাংলাদেশ। মেয়েদের মধ্যে ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ নারী সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল। তবে হতাশার খবর হলো রেংকিং এ দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। তবুও আশার বসতি গড়া।

 

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হওয়াটা যেন স্বপ্ন থেকে বেশিকিছু এখন বাংলাদেশের কাছে। অথচ দু’ দু’বার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা স্প্রিন্টার হয়েছিলেন মো. শাহ আলম। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ১০.৮০ সেকেন্ড ও ১৯৮৭ সালে দিল্লিতে ১০.৭৯ সেকেন্ড রেকর্ড সময় নিয়ে সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন।

মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে বাজিমাত করেন মোশাররফ হোসেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এশিয়ান গেমসে পদক জয় করেন। ১৯৮৬ এশিয়ান গেমসে মোশাররফ ব্রোঞ্জপদক জয় করেন।

মুজিবর রহমানের সোনার হাসি হাসে ১৯৮৪ সালে। নেপালের কাঠমণ্ডুতে ট্রিপল জাম্পে স্বর্ণ জিতলেন মুজিবর রহমান মল্লিক।

কমনওয়েলথ গেমসের শুটিংয়ে বাংলাদেশ সোনালি সময় পার করে এসেছে। ১৯৯১ সালের আসরে দেশের প্রথম নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন শুটার কাজী শাহানা পারভীন। কমনওয়েলথের আগে সে সময়কার কলম্বো সাফ গেমসেও পদক জিতেছিলেন এই তারকা নারী শুটার। এর আগে দুই শুটার আতিকুর রহমান আর আব্দুস সাত্তার নিনি ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমস পিস্তল শুটিংয়ে স্বর্ণ পদক জয় করেন।

আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনির পর ২০০২ সালে আরও একবার কমনওয়েলথ শুটিংয়ে স্বর্ণ পদক জয়ের অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন আসিফ হোসেন খান। যদিও বয়স ছিল তাঁর মাত্র ১৫।

গলফ খেলেই বিলিয়নিয়ার হয়েছেন টিইগার উডস নামের এক মার্কিন গলফার। এক টুর্নামেন্ট জিতলে ন্যূনতম আয় করা সম্ভব সেটিই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্যাডিবয় থেকে পেশাদার গলফার সিদ্দিকুর রহমান। ২০১০ সালে ব্রুনাই ওপেন জিতে হইচই ফেলে দেন সিদ্দিকুর।

বাংলাদেশের ভারোত্তোলনে বড় নাম মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। ২০১৬ সালের এসএ গেমসে তার কল্যাণেই ভারতের মাটিতে বেজেছিল জাতীয় সংগীত। সোনার পদক গলায় ঝুলিয়েছিলেন তিনি।

দেশের দ্বিতীয় অ্যাথলেট হিসেবে আর্চার রোমান সানা সরাসরি অলিম্পিকে খেলার টিকিট পেয়েছিলেন। দেশসেরা এই আর্চার ২০১৯ সালে বিশ্ব আর্চারিতে ব্রোঞ্জ জিতে হইচই ফেলে দেন। সেই অভাবনীয় সাফল্য তাকে পৌঁছে দিয়েছিল এবার ২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিক গেমসের সরাসরি খেলার সুযোগ।

 

বাংলাদেশের দাবার রানী রানী হামিদ তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে অনন্য এক ইতিহাসে নিজেকে নিয়ে গেছেন।

গিনেস বুক অব রেকর্ডসে টেনিসের রাজকন্যা লিনু। এই কিংবন্তী টানা ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন গিনেস বুক অব রেকর্ডসে।

দেশের ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকার নাম কাজি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। প্রথম পেশাদার ফুটবলার হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। তিনি ১৯৭৫ সালে হংকংয়ের প্রফেশনাল লিগে অংশ নিয়েছিলেন এফসি ক্যারোলিন ক্লাবের হয়ে।

বাংলাদেশের প্রথম সংগঠক হিসেবে ফিফার নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন মাহফুজা আক্তার কিরণ। তিনি প্রথমবার ফিফার কাউন্সিল মেম্বার হয়েছিলেন ২০১৭ সালে।

Views: 11