আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া

আমি ছোটবেলায় বাবা-মার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। তখন দেখতাম গ্রামের মানুষ নিত্য অভাব-অনটনের মধ্যে ডুবে থাকত। এক বেলা খেলে আরেক বেলা খেতে পারত না। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি ছিল জীর্ণশীর্ণ। গ্রামের বাড়িতে কোনো মেজবানের আয়োজন করলে গ্রামের মানুষ একবেলা ভালো খাবারের আশায় দলবেঁধে আসত।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে গেছে। আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে সেই আগের চিত্র আর দেখা যায় না। গ্রামগুলোতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামে আর জীর্ণশীর্ণ ঘরবাড়ি দেখা যায় না। গ্রামের প্রতিটি ঘর পাকা অথবা টিনের তৈরি। রাস্তাঘাট পাকা। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ আরও অনেক কিছু হয়েছে। আগে যেখানে গ্রামের মানুষ হেঁটে চলাচল করত এখন সেখানে বাস, ট্যাক্সি অথবা রিকশায় চলাচল করছে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ লাইন রয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিশের লাইনও রয়েছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আগে যেখানে পড়ালেখা করত না, এখন সেখানে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছে। আমাদের দেশের গ্রামগুলোর এ ধরনের পরিবর্তনের পেছনে গ্রামীণ অর্থনীতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতি অনেকটা গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ অর্থনীতি আবার কৃষির ওপর ভিত্তি করে চলে। আমাদের দেশে অতীতে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হতো। সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় তেমন ফসল উৎপন্ন হতো না। তাছাড়া তখনকার সময় নিত্য বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির কারণে ফসলের হানি হতো। আশানুরূপ ফসল না পাওয়ায় কৃষকরা নিত্য অভাব-অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন। বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষাবাদ করাতে ফসলের উৎপাদন আগের তুলনায় বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফসলের উপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখছেন। গ্রামীণ মৎস্য চাষে ইতোমধ্যে বিপ্লব ঘটে গেছে। আগে গ্রামে পুকুর বা দীঘিগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন হতো। বর্তমানে সেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছের চাষ করায় মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। গ্রামের তরুণ যুবকরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য খামার গড়ে তুলে আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে বিশ্বে চতুর্থ এবং মৎস্য চাষে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ লাখ ৫০ হাজার টন। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে, যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৮৪ হাজার টন বেশি।

মাছের উৎপাদন ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। আনন্দের খবর হলো, এই যে দেশের মৎস্য খাত বর্তমানে মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬১ শতাং জোগান দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এ উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশে রপ্তানির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। মৎস্য চাষের পাশাপাশি ডেইরি শিল্প অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমানে সারা দেশে ছোট-বড় সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ ২২ হাজার ২৮৯টি ডেইরি খামার রয়েছে। ডেইরি খামারগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন করছে তাতে দেশের মোট দুধের চাহিদা মিটে যাচ্ছে। ডেইরি ফার্মগুলোর বদৌলতে দেশে মাংসের উৎপাদন আগের তুলনায় সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মাংসের চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মাংস উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৭১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, যার বিপরীতে মাংস উৎপাদন হয়েছে ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টন। জানা যায়, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় দেশে মাংসের উৎপাদন ছিল ১০ লাখ মেট্রিক টন।

এখন সেই উৎপাদন বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি। দুধের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। আগে যেখানে কোরবানির ঈদের সময় গরুর জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো, এখন সেখানে দেশে উৎপাদিত গরু দিয়ে কোরবানির গরুর প্রয়োজন মিটছে। ডেইরি শিল্পের পাশাপাশি পোলট্রি শিল্পও অনেক এগিয়ে গেছে। দেশে কয়েক লক্ষ পোলট্রি খামারে উৎপাদিত মুরগি এবং ডিম দেশের মোট চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পের মাধ্যমে অনেকেই সচ্ছল হয়েছেন। গ্রামের অনাবাদী জায়গা আবাদ করে অনেকেই ফলের বাগান গড়ে তুলছেন। ফলের বাগানে উন্নত জাতের ফল গাছ লাগিয়ে ভালো ফলন পাচ্ছেন। গ্রামের মহিলারা কুঠির শিল্পের কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে। আমাদের দেশের কুঠির শিল্পের পণ্য সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। গ্রামের সঙ্গে শহরের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় গ্রামের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী সরাসরি শহরে নিয়ে আসছেন এবং তাদের পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন।

আমাদের দেশের গ্রামের অনেক তরুণ যুবক জীবিকার আশায় বিদেশে গেছেন। তারা বিদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। এতে করে তাদের পরিবারগুলোর জীবন যাত্রার মান অনেক বেড়ে গেছে। ইদানীং অনেক শিল্পপতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন। এতে করে গ্রামের মানুষ চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। বেকার সমস্যার কিছুটা সমাধান হচ্ছে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে শিক্ষার প্রসার ঘটছে। গ্রামের মানুষের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর আগ্রহ বাড়াতে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বহু স্কুল এবং কলেজ। এভাবে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ইতালির রোমে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) ৪১তম গভর্নিং কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করার জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়তে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি অনুধাবন করে বাংলাদেশ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করছে। এতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে। এখন সুষম উন্নয়ন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য আসছে। সরকারের সুচিন্তিত পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। উন্নয়ন-অগ্রগতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশকে অনুসরণ করে উন্নয়নের পথ খুঁজছে। এমনকি বিশ্বব্যাংকও দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশ রোল মডেলের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকপ্রধান নিজেই দারিদ্র্যে বিমোচনে বাংলাদেশের নেয়া উদ্যোগগুলো সরেজমিনে দেখে গেছেন। এসব প্রাপ্তি আমাদের জন্য বড় গৌরবের ব্যাপার। আমাদের এ অর্জনকে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে।

লেখক: আবুল কাসেম ভূঁইয়া