বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স

একসময়ের নিন্দিত বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বে নন্দিত ও প্রশংসিত। পরনির্ভশীল ও তলাবিহীন ঝুড়ির দেশে স্বাধীনতার আগে ও পরে অভাবী লোকের সংখ্যা ছিল ৮৫ শতাংশ। কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির কারণে পেটে ছিল না ভাত, শরীরে ছিল না কাপড়, অপুষ্টি, রোগাক্রান্ত মানুষের দেহ ছিল কঙ্কাল, চেহারা ছিল মলিন। রাজাকোষ ছিল শূন্য। বন্ধুরাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল কম। বিশ্বে বাংলাদেশ নিয়ে ছিল নেতিবাচক মনোভাব। সব বদনাম মুছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ জুড়ে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। বিদেশে বন্ধুরাষ্ট্রের সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশের আপদে-বিপদে তারা পাশে দাঁড়ায়। কারো রক্তচক্ষুতে ভয় পায় না বাংলাদেশ। পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স উন্নয়নের এখন মূল চালিকাশক্তি। বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে নতুন করে বিশ্ব অনুসরণ ও অনুকরণ করছে।

দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়নের সমস্যাটি জটিল। মাথাপিছু আয় ৫০-৭০ ডলার। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য চরম। নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফ্যাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন এক বইয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, যে কোনো দেশই উন্নয়ন করতে পারবে।’

পঞ্চাশ-ষাটের দশকের দিকে এ দেশের কিছু লোক যুক্তরাজ্যে যাত্রা করেন। এই ভূখণ্ডের হজযাত্রীরা ভারতীয় ভিসা নিয়ে হজে যেতেন। বঙ্গবন্ধু সৌদি বাদশাহর সঙ্গে আলোচনা করার পর হাজিরা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে হজে যাওয়া শুরু করেন। সে সময় থেকে আরব বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি ঘটে এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়।

প্রবাসীরা দেশের অমূল্য সম্পদ। তাদের ঘাম জরানো কষ্টার্জিত অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গমন করেন, এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ অদক্ষ। বিবিসি বাংলা বলেছে, প্রতি বছর ১৭২টি দেশে বাংলাদেশি ২০ লাখ শ্রমিক গমন করেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন সাড়ে ৫ লাখ, এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ সিলেটি। ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত বৈধভাবে দেড় কোটিরও বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী ১৭২টি দেশে অবস্থান করছেন, এর মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি নারী রয়েছেন। অবৈধ বা সমুদ্রপথে ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক দেশে হাজার হাজার লোক যাচ্ছে। রাস্তায় অনেকের করুণ মৃত্যুও হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি লোক বিদেশে অবস্থান করছেন। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে বিশ্বে মেধাবী শিক্ষার্থীরাও স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন, এদের মধ্যে মেয়েরা বেশি। স্টুডেন্ট ভিসায় যেতে IELTS পরীক্ষা দিতে হয়। অধিকাংশ মেধাবী রোজগারের আশায় বিদেশে চলে যাচ্ছেন। একসময় হয়তো দেশে মেধার তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে।

গত ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে তরুণ সাংসদ হাবিবুর রহমান হাবিবের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার মেধা পাচার রোধে চেষ্টা করছে, কিন্তু মেধা পাচার রোধ খুবই দুরূহ ব্যাপার। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সংসদকে জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ বিলিয়নেরও বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন এবং ২০২৩ সালের জুন মাসে আসে ২১৯ কোটি, জুলাই মাসে ১৯৭ কোটি মার্কিন ডলার, আগস্টের ১১ দিনে রেমিট্যান্স আসে ৬৯ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে আরো ৩ শতাংশ রেমিট্যান্স বাড়তে পারে।

২০২১ সালে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর শর্তমতে, গত ১৪ জুনের ঋণের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নতির কথা। সেদিন প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৬ কোটি মার্কিন ডলার। তবে মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৯৯৭ কোটি মার্কিন ডলার। প্রকৃত রিজার্ভ হিসাব করতে ৬৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ বাদ দেওয়া হয়েছিল। জুন মাসে রিজার্ভ ছিল ৬ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আমদানি খরচ ছিল ৬৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। ১৯৭১ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৮৮ ডলার, ’৭৬ সালে ছিল ৬৭০ ডলার, ২০২১ সালে ২ হাজার ৫৯১ ডলার, ২০২৩ সালে ২ হাজার ৭৬৫ ডলার এবং ২০৪১ সালে হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।

২০১৮ সালে দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন গ্লোবাল রিসার্চ, বাংলাদেশকে এশিয়ার ইমাজিং টাইগার বলে স্বীকৃতি দেয়। এইচএসবির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ২৬তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশ। অক্সফাম ও ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল ইতিপূর্বে এক সমীক্ষায় বলেছে, ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৮, ভারত ১৪৭, নেপাল ১৩৯, পাকিস্তান ১৩৭ সূচক থেকে বৈষম্য দূর করার যুদ্ধে সফল হয়েছে। গোল্ডম্যান শ্যাকসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৭৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১৬তম অর্থনীতির বড় দেশ হবে বাংলাদেশ। দেশের জিডিপিতে মোটা দাগে তিনটি খাত কৃষি উত্পাদন, শিল্প উত্পাদন ও সেবা খাতে মোট ১৫ ধরনের সেবা খাতের সম্মিলিত যোগফলকে মোট জিডিপি বলা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু সরকারি হিসাবে অর্জন করে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি মানে, দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। ২০৭৫ সালে জিডিপির মোট দেশজ উত্পাদনের আকার দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন ডলার সমান ১ লাখ কোটি ডলার)। তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সৌদি আরব, কানাডা, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। তখন চীনের জিডিপির আকার হবে ৫৭ ট্রিলিয়ন, ভারতের ৪২ ট্রিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের ৫১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিএমইটির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাসের শুরুতে জনশক্তি রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়ে। রেমিট্যান্সের বড় বাধা প্রবাসীদের কাজের অদক্ষতা, যে কারণে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বিদেশে বেশি পরিশ্রম করেও কম অর্থ উপার্জন করছেন। বর্তমান সরকার রেমিট্যান্স বাড়ানোর লক্ষ্যে ৮ লাখ ১০ হাজার বিদেশগামী কর্মীর প্রশিক্ষনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৫ লাখ ২০ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিএইবিএস)-এর ২০২১ সালের জরিপ মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পাশ করা ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার, ২১ শতাংশ বিনা প্রশিক্ষণে এবং ৭ শতাংশ প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করেন। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট বলেছে, প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি পান না ৪৭ শতাংশ। সাময়িকীটি বলেছে, উচ্চশিক্ষায় বেকারত্ব তৈরি হলে দেশ ও সমাজের অনেক ক্ষতি হয়। কারিগরি শিক্ষায় অভিজ্ঞ থাকলে প্রবাসীরা পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। কারিগরি শিক্ষা মূলত পেশাগত কর্মের মূল শক্তি। তাই বিদেশে যাওয়ার আগে ইচ্ছুকদের একটি নির্দিষ্ট কাজ শিখে যেতে পারলে বেশি উপার্জন সম্ভব।

রেমিট্যান্স বৃদ্ধির স্বার্থে সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। (১) দেশ-বিদেশে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্বে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, (২) আমাদের বিদেশি মিশনগুলো প্রবাসীদের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানো এবং রেমিট্যান্স বৈধভাবে পাঠানোর উত্সাহ প্রদান ও প্রচার করা, (৩) রেমিট্যান্সের প্রণোদনা বাড়ানো, (৪) এয়ারপোর্টে যাত্রী হয়রানি বন্ধ এবং বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া কমানো, (৫) প্রবাসীদের বাড়ির জমি দখল রোধ ও নিরাপত্তা প্রদানে আইন প্রণয়ন করা, (৬) একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের সম্মানে বিভিন্ন খেতাবের প্রচলনসহ প্রয়োজনীয় ব্যস্থা গ্রহণ করা।

একসময় বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরি ফসল ছিল পাট। বর্তমান সময়ে রেমিট্যান্স, উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের অর্থনীতির চাকা পেছন দিকে ঘুরতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লাগাতার তিন মেয়াদ (২০০৮-২০২৩) সময়ে দেশের অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমালোচকেরা তা স্বীকার না করলেও বিশ্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন স্বীকৃত ও প্রমাণিত। পরিশেষে বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানী JC MAXWELL নেতার সজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, A LEADER IS ONE, WHO KNOWS THE WAY, GOES THE WAY AND SHOWS THE WAY, বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী পরিকল্পনা, চিন্তা-চেতনা, সত্ সাহসিকতা, বিচক্ষণ ও চৌকশ নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এই সজ্ঞার শতভাগ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শেখ হাসিনার সফল কর্মের হাত ধরেই উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখবে বাংলাদেশ।

লেখক:এ এইচ এম ফিরোজ আলী, কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক