ইন্টারনেটভিত্তিক বৃহৎ তথ্য উপাত্ত সুরক্ষা কেন্দ্র হচ্ছে

বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় দেশে স্থাপন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা কেন্দ্র ‘টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার’। অনলাইনভিত্তিক (ইন্টারনেট) কার্যক্রমের তথ্য ও উপাত্ত নিরাপদে সংরক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এ কেন্দ্র ব্যবহার করা হবে। চাহিদামাফিক অধিক ধারণক্ষমতার এ ডাটা সেন্টারটিতে বাণিজ্যিকভাবে অর্থাৎ অন্য দেশের ইন্টারনেটের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণেরও সুযোগ থাকছে। সেন্টারটি আট মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় হবে। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ ডাটা সেন্টারটি স্থাপনের কাজ সেপ্টেম্বরে শুরু করবে সরকার। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে এ ডাটা সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তির মহাসড়কে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে আশা করছেন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।
তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে সাড়ে সাত একর জমির ওপর টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এটি হবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী ডাটা সেন্টার। সার্ভার, কম্পিউটার, ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ ডাটা সেন্টারটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্যের পরিমাণ ১৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা)। এই টাকা চীন সরকার ঋণ হিসাবে দিতে সম্মত হয়েছে। দুই দেশের ঋণ নীতিমালা অনুসরণ করে গভর্মেন্ট টু গভর্মেন্টের (জিটুজি) আওতায় এ ডাটা সেন্টারটি নির্মাণে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা জেডটিই হোল্ডিংস এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জেডটিই কর্পোরেশনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাকি ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩১৮ কোটি টাকার জোগান দেয়া হবে সরকারের তহবিল থেকে। এই অর্থ ব্যয় হবে ট্যাক্স-ভ্যাট ও বেতন-ভাতাদি বাবদ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। যুক্তরাষ্ট্রের আপটাইম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ডাটা সেন্টারটি নির্মাণে করিগরি নির্দেশনা ও তদারকি করবে।
আইসিটি বিভাগ সূত্র মতে, ৮ হাজার বর্গমিটার ফ্লোর স্পেস বিশিষ্ট টায়ার ফোর ডাটা সেন্টারটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক গুণগত মান নিশ্চিতকরণ ও নকশা প্রণয়নে আপটাইম ইনস্টিটিউটকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর প্রাক্কলিত প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আপটাইম ইনস্টিটিউট প্রকাশিত কস্ট মডেল বিবেচনায় নেয়া হয়। এ ইনস্টিটিউটের হিসাবে ৮ হাজার বর্গমিটারের স্পেসে একটি টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার নির্মাণে ট্যাক্স ও ভ্যাট, বেতন ভাতাদি খরচ বাদে ব্যয় হয় ১৫১ মিলিয়ন ডলারের বেশি। জাতীয় ডাটা সেন্টারের পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ মানবকণ্ঠকে বলেন, টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার স্থাপন নিয়ে চীনের প্রতিষ্ঠান জেডটিইর সঙ্গে কমার্শিয়াল নেগোশিয়েশনের সময় তাদের দেয়া আর্থিক প্রস্তাবের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান আপটাইম ইনস্টিটিউটের প্রণীত ব্যয়ের হিসাব বিবেচনায় নেয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি ডাটা সেন্টারের মান নিশ্চিত পূর্বক টায়ারের সনদ দিয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমান সরকারের রূপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায় আগামী কয়েক বছরে দেশে ব্যাপকভাবে অনলাইনভিত্তিক (ইন্টারনেট) তথ্য ও ডাটা (উপাত্ত) তৈরি হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ভূমি মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগে ডিজিটাইজেশনসহ ই-গভর্মেন্ট অ্যাপ্লিকেশনস, ই-সেবা, ই-কমার্স, ই-শিক্ষা, ই-স্বাস্থ্য, ই-ব্যাংকিং আরো ব্যাপকভাবে চালু করা হবে। যা রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে অবস্থিত টায়ার থ্রি ডাটা সেন্টারে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। এটির ধারণ ক্ষমতা ৭৫০ টেরাবাইট, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তাই এর কয়েক হাজার গুণ বেশি ধারণক্ষমতার নতুন টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো সময়ে ধারণক্ষমতা বাড়ানোর সুবিধা থাকছে নতুন ডাটা সেন্টারে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তথ্য-উপাত্তের সংরক্ষণে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এটা কাজ করবে। থাকবে সুরক্ষিত ও নিরাপদ। ডাটা সেন্টারটির স্থায়িত্ব এতো শক্তিশালী হবে যে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও কোনো ক্ষতি হবে না। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশ তথ্য-উপাত্ত এখানে সংরক্ষণ করতে পারবে। এতে চার বছরে নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে বলে আশা করছেন তারা।
সূত্র জানায়, টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতীয় ডাটা সেন্টারের পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ এবং স্থপতি বদরুল হায়দারকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা সরকারের চলমান ডিজিটাইজেশন কার্যক্রম ও বাস্তবতা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনুরূপ ডাটা সেন্টারের অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেশে টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দেন। পাশাপাশি আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও সিটিও ফোরামের সভাপতিসহ দেশের অন্য বিশেজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটিও এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন দাখিল করে। যার ওপর ভিত্তি করেই সরকার ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়।
এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণ এবং সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ও তথ্য-সেবার ডিজিটাইজেশনের ফলে দেশে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাটা সেন্টার স্থাপন অনিবার্য। এ লক্ষ্যে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের তথ্য ও ডাটা সুরক্ষার জন্য কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে টায়ার ফোর ডাটা সেন্টারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি নির্মাণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। আগামী সেপ্টম্বরে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং-এর ঢাকায় সফর এবং টায়ার ফোর ডাটা সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা রয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার মানবকণ্ঠকে বলেন, শুধু টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার নয়, সরকার ভূমিকম্পের কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা যশোরে একটি ডিজাস্টার রিকোভারি (ডিআরসি) সেন্টারও করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করার জন্য এ দুটি প্রকল্প অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বিসিসির নির্বাহী পরিচালক এস এম আশরাফুল ইসলাম বলেন, টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার স্থাপনের আগে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয় সরকার। এক. সম্ভাব্যতা যাচাই এবং দুই. চীন সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যয়। এ লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।