জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী ॥ বাংলাদেশের অর্জন

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা ও তাঁর সফরসঙ্গীরা নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে  পৌঁছেন।

সেখানে তিনি ২১ সেপ্টেম্বর থেকে  ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবস্থান এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী অধিবেশনে যোগদান করেন। ২২ সেপ্টেম্বর অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ বছর সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু ইস্যুর পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়াযুদ্ধ।  ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে সাধারণ সভার আলোচনা।

‘বিশ্বাস, পুনর্গঠন ও বিশ্ব সংহতির পুনরুদ্ধার’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের সাধারণ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মহামারি মোকাবিলা ও পরমাণু অস্ত্র বাতিল করার বিষয়েও আলোচনা হয়। জাতিসংঘের বার্ষিক আয়োজনের মধ্যে এই বিতর্কের প্রতি নজর থাকে বিশ্ববাসীর। এই বিতর্কে বিশ্বনেতারা আগামী বছরের জন্য তাদের অগ্রাধিকার তুলে ধরার সুযোপ পান। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সহযোগিতার আহ্বান জানান। কখনো কখনো প্রতিদ্বন্দ্বীদের মৃদু সমালোচনাও করেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসের বক্তব্য

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে  জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বলেছেন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার কারণে বিশ্ব অস্থির হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি; উত্তর ও দক্ষিণ এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিভক্তি গভীরতর হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। বৈশ্বিক ব্যবস্থা এমন এক সময়ে ‘পশ্চাৎপদ অবস্থান’ নিয়েছে, যখন শক্তিশালী, আধুনিক ও বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন রয়েছে। যদি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বকে তার মতো করে প্রতিনিধিত্ব না করে, তাহলে আমরা কার্যকরভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারি না। সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে, প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যার অংশ হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে। অকার্যকর, সেকেলে ও অন্যায্য আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামোর বড় ধরনের সংস্কারের আহ্বানও জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

প্রধানমন্ত্রী ১৯ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের প্রথম দিনের সাধারণ বিতর্কে অংশ নেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাইডেন ৭৮তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে নিউইয়র্কে আগত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মানে সন্ধ্যায় মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট-এ ভোজসভার আয়োজন করেন। যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নৈশভোজেও। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর সায়মা ওয়াজেদ এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী এবং ইইউ সভাপতির বৈঠক

একই দিন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সভাপতি আয়োজিত ‘টুওয়ার্ডস অ্যাফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈশ্বিক সংকট কাটাতে আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাপী ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এটি বর্তমানে অনেক নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য তহবিলের সুবিধা সীমিত করেছে। তিনি বলেন, আমরা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে একমত যে,  বৈশ্বিক ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম অবশ্যই পর্যালোচনা করা উচিত। বর্তমান রেটিং সিস্টেম অনেক নি¤œ এবং মধ্যম আয়ের দেশের জন্য তহবিলের সুবিধাকে আরও সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, তাদের ভোটাধিকার, কোটা এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবিএস) এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (আইএফআইএস) প্রতিনিধিত্বের সীমা তাদের দর কষাকষির ক্ষমতাকেও ক্ষুণœ করে। তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই আন্তর্জাতিক পাবলিক ফাইন্যান্সগুলোকে ব্যয়বহুল এবং নাগালের বাইরে দেখতে পাই। ঋণের ঝামেলা এড়াতে আমরা উচ্চসুদের ঋণ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ কখনই ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি এবং আমরা সেই রেকর্ড বজায় রাখার আশা করি। আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচারের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধিত্ব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার জন্য আমাদের প্রত্যাশার প্রতি সায় দেওয়ার সময় এসেছে।

তিনি বলেন, আমরা স্বীকার করি যে, আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচারের জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সংস্কারের প্রকৃতি ও পরিধির বিষয়ে চুক্তির ক্ষেত্রে এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। মহাসচিবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, এমডিবি, আইএফআই এবং বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে তাদের অগ্রাধিকারগুলো পুনরায় সাজাতে হবে এবং এসডিজি বাস্তবায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলার জন্য অতিরিক্ত তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয় দফা সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বল্প ব্যয়ে, রেয়াতি হারে পর্যাপ্ত তহবিলের প্রয়োজন এবং পছন্দসই উচ্চমানের বিপুল পরিমাণে অনুদান এবং সমস্ত ঋণদানের উপকরণগুলোতে দুর্যোগের ধারা থাকতে হবে, যাতে দুর্বল দেশগুলো সংকটকালের ধাক্কা সামলাতে পারে। চতুর্থ দফা সম্পর্কে তিনি বলেন, ঋণদাতাদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে ন্যায্য ও কার্যকর ঋণ হিসেবে ত্রাণ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পঞ্চম এবং শেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটার পরিবর্তে এসডিআর ঋণের সীমা প্রয়োজন এবং সীমাবদ্ধতার ভিত্তিতে সহজ ঋণ প্রক্রিয়ার  মাধ্যমে হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তার সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য সুনাম কুড়িয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল ও ব্রাউন ইউনিভার্সিটির সম্মাননা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরির জন্য জাতিসংঘ স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে এই বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিক্যাল স্কুলের মেডিসিন অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের ডিন ডা. মুকেশ কে. জৈন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর অবস্থানস্থল দি লোটে নিউইয়র্ক হোটেলে প্রশংসাপত্রটি হস্তান্তর করেন। প্রশংসাপত্রে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ কর্তৃক ‘শেখ হাসিনা উদ্যোগ’-এর সাম্প্রতিক স্বীকৃতির জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। এতে আরও বলা হয়, কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি সফল মডেল : প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং কমিউনিটি সম্পৃক্ততা উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিধির জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ড. জৈন জনস্বাস্থ্য ও গবেষণার ক্ষেত্রে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি সম্ভাব্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাংলাদেশ-ব্রাউন বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন ইনিশিয়েটিভ সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে চিকিৎসা ও ক্লিনিক্যাল গবেষণার উন্নয়নের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, আমরা সবসময় গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের পরীক্ষা করছে। ড. জৈন আরও বলেন, তারা ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী রোগীদের রেকর্ড রাখার জন্য বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিককে ইলেকট্রনিক ডেটা ম্যানেজমেন্ট চালু করতে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটি গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অংশীদারিত্ব গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এ লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ভুটান, চীন, মালয়েশিয়া, চ্যাথাম হাউস ও সূচনা ফাউন্ডেশনসহ আয়োজিত চিকিৎসা পরিষেবাভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টেও শেখ হাসিনা যোগ দেন।

নারীর ক্ষমতায়নে জাতিসংঘ

নারীদের জীবনে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত  গ্রহণে প্রভাব ফেলতে তাদের অবশ্যই নেতৃত্বের অবস্থানে থাকতে হবে বলে মতপ্রকাশ করেন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও বলেন, নারীদের নেতৃতে এনে জাতিসংঘকে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এটা দুঃখজনক যে, জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সময় এসেছে, আমরা শীঘ্রই একজনকে পাব। আমাদের অবশ্যই নিজেদের অংশীদারিত্বের ভিত্তি বাড়াতে হবে, যাতে সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা একটি আদর্শ হয়ে ওঠে। নারীর অংশগ্রহণকে উচ্চতর পর্যায়ে এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।

নেতা হিসাবে আমাদের তাদের সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে এবং তাদের এই বিষয়ে সাহসী উদ্যোগ নিতে উৎসাহী করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি দেশ আলাদা এবং তাদের ভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে। তবে, সবাই যেহেতু ঐতিহাসিক এজেন্ডা ২০৩০ গ্রহণ করেছে, সেহেতু তাদের লিঙ্গ সমতা অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা উচিত। আমরা কোনো অবস্থাতেই সেই অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে যেতে পারি না। নারী নেত্রী হিসেবে, সব নারীর পাশে দাঁড়ানো এবং অন্যদের পথ দেখাতে পারে এমন উদাহরণ তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব। একটি লিঙ্গ সমতার বিশ্ব অর্জনের জন্য অবশ্যই আমাদের অবস্থান এবং শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে সূচনা হওয়ার পর থেকে এই প্ল্যাটফর্মটি খুবই দরকারি কাজ করছে। এখানে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করি এবং একে অপরের কাছ থেকে শিখি যে, কিভাবে স্থানীয় সমাধানগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যাকে পেছনে ফেলে শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা কোনো ফল দেবে না। লিঙ্গ সমতা একটি বিকল্প নয়, বরং একটি ন্যায্য ও ন্যায়সম্মত বিশ্ব অর্জনের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। যার ফলে জনগণ ছাড়া আর কোনো সম্পদ ছিল না। সুতরাং আমরা আমাদের সমগ্র মানবসম্পদ পুঁজিকে কাজে লাগানো এবং একটি সমৃদ্ধ দেশ গঠনে আমাদের সমান অংশীদার হিসেবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে নারীদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা’ শীর্ষক  ব্রেকফাস্ট সামিট ও ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সভায় যোগ দেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিবের জেনোসাইড উপদেষ্টা, নবনির্বাচিত ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) মহাপরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন ও শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গেও জাতিসংঘ সদর দপ্তরের দ্বিপক্ষীয় বুথে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।

জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রাপ্তি

দক্ষিণ এশিয়ায় যে কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী তাদের মহান কাজের জন্য চির অমরতা লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা অন্যতম। তিনি বিশ্বের বিস্ময় হয়ে উঠেছেন নিজ কর্মগুণে। শেখ হাসিনা তাঁর নিজস্ব জ্ঞান ও চিন্তাচেতনাকে কাজে লাগিয়ে একটি স্বল্পোন্নত দেশকে খুব কম সময়ে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে এসেছেন। তিনি দেশের উন্নয়নের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সব সময় আপোসহীন ছিলেন। তিনি তাঁর সরকারের আমলে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাকা-ের পর তৎকালীন সরকার এই বিচার না হওয়ার জন্য ইনডেমনিটি নামক কালো আইন করেছিল। সেই কুখ্যাত আইন সরকার বাতিল করে এবং সেই হত্যাকান্ডের বিচার শুরু করে। বিচারের রায়ও কার্যকর করে। সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি,  আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, সারাদেশে প্রায় ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্তিকরণ, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে সুসংহত রূপ দান ইত্যাদি।

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যা। সেখানেও তিনি মানবতার দুয়ার খুলে রেখেছেন, এটা এক অনন্য অবদান। সমাজ ও দেশের জন্য তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজ তাঁকে একজন আলোকিত মানুষ করে তুলেছে। পরিশেষে বলতে চাই, শেখ হাসিনা বিশ্বের অনুন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এখন রোল মডেল।  এই  বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বিশ্বদরবারে উপস্থাপন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় গৌরবের অর্জন।

লেখক : অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য

ড.মিহির কুমার রায়
সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা