চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ

বিশ্বের সকল নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রনায়কই উপলব্ধি করিতে পারিতেছেন যে, মানব জাতিকে বাঁচাইতে হইলে ধরিত্রীর উষ্ণতাবৃদ্ধির লাগাম টানিয়া ধরিতেই হইবে। কিন্তু সেই লাগামের সহিত যুক্ত অর্থনীতিরও লাগাম। স্বভাবতই ধরিত্রীর উষ্ণতাবৃদ্ধির লাগাম টানিয়া ধরিতে যে ধরনের কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে, শিল্পোন্নত বেশির ভাগ দেশই তাহা করিতে প্রথমাবধি গড়িমসি করিয়া আসিতেছে। বাংলাদেশ, ছোট দেশ হইলেও, এইক্ষেত্রে রাখিয়া চলিতেছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সেই দৃষ্টান্ত হইল সাহস, সময়োচিত পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার এক অপূর্ব সমন্বয়। আর এই দুরূহ কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করিতে মূখ্যভূমিকা পালন করিতেছেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী গতকাল সোমবার অর্জন করিয়াছেন জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’।

বাংলাদেশ এ-বিশ্বের প্রথম দেশ, যে দেশটি নিজস্ব তহবিল দ্বারা ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করিয়াছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করিবার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম তিন বত্সরে এই ফান্ডে বরাদ্দ দিয়াছেন ৩০ কোটি মার্কিন ডলার! শুধু তাহাই নহে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়—যেখানে রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক নির্দেশনা দেওয়া হইয়াছে বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে। তাহা ছাড়া, প্রণীত বন নীতিমালায় সংবিধানে জলাভূমি এবং বণ্যপ্রাণী রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হইয়াছে, যাহা কাজ করিতেছে আবহাওয়ার বেশকিছু চরমভাবাপন্ন অবস্থার প্রতিকার হিসাবে। পাশাপাশি দেশে বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাইয়াছে প্রায় ১০ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে সরকার দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপও করিয়াছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে গড়িয়া উঠিয়াছে বিশ্বের সর্ববৃহত্ সোলার হোম সিস্টেম, যাহা গ্রিড বহির্ভূত অঞ্চলের ১০ শতাংশ জনগণের বিদ্যুত্ চাহিদা মিটাইতেছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ গ্যাস নির্গমন উত্স হইল প্রথাগত ‘ইটভাটা’, যাহা হইতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসেরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের এইরূপ তালিকা দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইবে। সুতরাং বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হইয়াছেন—তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই।

তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের কারণে পৃথিবীকে ‘বিশ্বগ্রাম’ বলা হইলেও জলবায়ুর বিষয়ে এই কথাটি প্রকৃতিগত ভাবে সবচেয়ে বড় সত্য। ধরা যাক, এই ‘বিশ্বগ্রাম’ তিন-চতুর্থাংশ জলমগ্ন, আর সেই পানির ওপর সিকিভাগ আকারের একটি বিক্ষিপ্ত নৌযানে আমরা ভাসমান রহিয়াছি। সেই নৌযানের কোথাও যদি ছিদ্র হয়, তাহাতে যদি নৌযানটি ছিদ্রযুক্ত অঞ্চলে দ্রুত ডুবিতে থাকে; আর যাহারা তুলনামূলক উপরিভাগে রহিয়াছে, তাহারা যদি মনে করেন—‘আমাদের তাহাতে কী? আমাদের অংশে তো ছিদ্র হয় নাই?’—তবে স্মরণ করিতে হইবে সেই প্রবাদবাক্যটির কথা—নগর পুড়িলে দেবালয়ও এড়ায় না। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানাইয়াছেন, ১৯৫০ হইতে এখন অবধি অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাইয়াছে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় যে পরিমাণ বরফ রহিয়াছে তাহার সবটুকু যদি গলিয়া যায়, তাহা হইলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাইবে ১১ ফুট! বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমগ্র বিষয়টি যেন আত্মঘাতী বোমার সলতেয় আগুনের স্পর্শ লাগিবার মতো। তাই সময় যতটুকু রহিয়াছে, ততটুকুর মধ্যেই প্রকৃতি রক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে সবাইকে। তাহা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও অনুভব করিতে পারিয়াছেন। তিনি চাহিতেছেন—২০০৫ সালের মাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন ৩২ শতাংশ কমানোর চুক্তি করা হোক। তিনিও মনে করেন—আগামীকাল নহে, এখনই উদ্যোগী হইতে হইবে উষ্ণতার লাগাম টানিয়া ধরিতে। উষ্ণায়ন কোনো সায়েন্স ফ্যান্টাসি নহে।

ইহা স্পষ্ট যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত সাহস, পরিশ্রম, ধৈর্য, একাগ্রতা, অবিচলতা আর নিষ্ঠা তাঁহার চলার পথের পাথেয় হইয়া উঠিয়াছে—যাহার কিয়দ্খানিক স্বীকৃতি উঠিয়া আসে ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’-জাতীয় পুরস্কারে। ভবিষ্যত্ বাংলাদেশ নিশ্চিত করিয়াই বিশেষভাবে অনুধাবন ও মূল্যায়ন করিবে শেখ হাসিনার দূরদর্শী-নেতৃত্বের জামানাকে। অভিনন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।