সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নে কাজ করবে মেরিটাইম ভার্সিটি

বিশ্বে এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে মাত্র ১২টি, এশিয়াতে তিনটি

সমুদ্রবিজ্ঞানে দক্ষ জনবল তৈরি করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয়। এই বিশ^বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভের পর অনেকেই বড় অবদান রাখছেন দেশের জাহাজ শিল্পে। যার প্রভাবে এই শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন এদেশের মানুষ। অথচ কিছুকাল আগেও বিদেশী ছাড়া এসব দায়িত্ব পালন ছিল প্রায় অসম্ভব। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু মেরিটাইম উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য কাজ করছে তা নয়, দেশের সামুদ্রিক অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে প্রস্তুত হচ্ছেন। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সামুদ্রিক অর্থনীতিই পাল্টে দেবে। দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল ও সমুদ্র নিরাপত্তা গবেষক মোহাম্মদ মুসা বলেছেন, অপার সম্ভাবনাময় দেশের সামুদ্রিক অর্থনীতি।

তেল-গ্যাস, খনিজসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র বিজয়ের পর এখন বাংলাদেশের সামুদ্রিক সীমানা এক লাখ ১৮ হাজার বর্গ কি.মি.। দীর্ঘ এই সমুদ্রসীমায় প্রযুক্তির অভাবে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষ জনবল না থাকায় সামুদ্রিক পর্যটনের যে হাতছানি সেটিও থমকে আছে। তবে আশা দেখাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয়। বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয়টি যে পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে তাতে সামুদ্রিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে বড় অবদান রাখবে।
জাহাজ শিল্পে অবদান প্রসঙ্গে উপাচার্য মোহাম্মদ মুসা বলেন, দেশের জাহাজ শিল্পের অর্ধেক জনবল ছিল বিদেশী। তারা মোটা বেতনে এখানে কাজ করতেন। এই বিশ^বিদ্যালয়ে যারা শিক্ষা লাভ করেছেন তাদের অধিকাংশই জাহাজ শিল্পে বড় অবদান রাখছেন। যার প্রভাবে এই শিল্পে এখন বিদেশী নেই বললেই চলে। নেভাল আর্কিটেকচার, ওশানোগ্রাফি, পোর্ট ম্যানেজমেন্ট, মেরিন ফিশারিজ ও মেরিটাইম আইনের মতো বিষয়ে প্রতিবছর ২০০ শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন।

তারা শুধু মেরিটাইম উৎকর্ষ অর্জনে কাজ করছে তা নয়, দেশের সামুদ্রিক অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে প্রস্তুত হচ্ছেন। তবে স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয় মিরপুরের ১২ নম্বরে দুটি ভবনে পরিচালিত হচ্ছে। দুটি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। অস্থায়ী ক্যা¤পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় নতুন কোনো বিষয় খোলা যাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের অবস্থান প্রসঙ্গে রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘কেন চট্টগ্রাম নয়Ñকেন খুলনা নয়Ñএই প্রশ্ন আমারও। শেষমেষ চট্টগ্রামের হামিদচর এলাকায় ১০৬ একর জায়গাজুড়ে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হচ্ছে। বড় জায়গা পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু সরকার একটি বড় জায়গা আমাদের দিয়েছে। স্থায়ী ক্যা¤পাসে মাটি ভরাটের কাজ স¤পন্ন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের মেরিটাইম ভিশনের অংশ হিসেবে এটি বিশেষায়িত প্রথম বিশ^বিদ্যালয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন তিনটি এবং পৃথিবীতে ১২টি বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বিষয় পড়ানো হয় তার চাহিদা ব্যাপক। স্নাতক, স্নাতকোত্তর বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করা হচ্ছে সমুদ্র ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মুসা বলেন, আইন বিষয়ে অনেকেই পড়ায়। কিন্তু সমুদ্র চলাচলে যেমন  নৌ সীমানা রয়েছে। সেসব বিষয়েও আইন জানা দরকার। সেই নিরিখে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা হচ্ছে এখানে। এখানে পোর্ট অ্যান্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট পড়ানো হয়। জাহাজগুলো কিভাবে আসে কিভাবে পণ্য খালাস করে-এসব বিষয় সহজেই শিখতে পারছে শিক্ষার্থীরা। পোর্ট কিভাবে চলবে তা জানারও সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের নৌবন্দর, বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, সমুদ্র বন্দরেও এসব শিক্ষার্থীরা পাস করে চাকরি পাচ্ছেন। হচ্ছেন সমুদ্র সংক্রান্ত উদ্যোক্তা।
সমুদ্র নিরাপত্তা গবেষক রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখনো গভীর সমুদ্রে মাছ ও খনিজ আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজন আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গবেষণা। এখানে গবেষণা ও তাত্ত্বিকভাবে জ্ঞানার্জনের সুযোগ রয়েছে। সমুদ্রে যে জীববৈচিত্র্য রয়েছে, তা থেকে ওষুধও তৈরি করা যায়। সমুদ্র আমাদের দেশের বড় একটি সম্পদ। এসব নিয়েও গবেষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।’
উপাচার্য মোহাম্মদ মুসা বলেন, সমুদ্রের সব বিষয় প্রযুক্তি ও আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাসসহ বিদেশীরা এখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে বিশ^মানের এবং দেশের সেরা তিনটি ল্যাব রয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল ভিজিট ও গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আমাদের একটি রিসার্চ সেন্টার ও সামুদ্রিক ভ্যাসেল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সুবিধার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়বে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ এখানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরিচালনা করেন। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের স্বার্থে নিয়মিত বিভিন্ন পোর্ট, ডকইয়ার্ড ও গভীর সমুদ্রে গবেষণা ও শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়।
তিনি বলেন, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করার সঙ্গে সঙ্গে শুধু বিদেশী শিক্ষার্থী নয়, বিদেশী শিক্ষকও বাড়বে বিশ^বিদ্যালয়ে। ইতোমধ্যে নেদারল্যান্ডস, ভারত ও চীনের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, নৌবাহিনীর অভিজ্ঞ, মেকাানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী ও সমুদ্র সংক্রান্ত বিষয়ে যারা ব্যবসা করছে, তারা পড়াচ্ছেন। এখানে ফ্যাকাল্টিগুলো বৈচিত্র্যময়। শিক্ষার্থীরাও কৌতূহলী। মফস্বল থেকে অনেক শিক্ষার্থী আসছে। আলাদা তিনটি হল আছে। দুটি ছেলেদের ও একটি মেয়েদের। ক্যাম্পাসে যাতায়াতে বাস সার্ভিসও আছে।

উপাচার্য মোহাম্মদ মুসা জানান, সাতটি প্রতিষ্ঠান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত আছে। এরমধ্যে পাঁচটি সরকারি- একটি বেসরকারি মেরিন একাডেমি ও একটি সরকারি ফিশারিজ। এসব প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম নির্ধারণ, পরীক্ষা ও সনদ প্রদান করা হচ্ছে। সব কিছু মনিটরিংও করা হয় এখান থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব বে অব বেঙ্গল অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ নামক একটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট চালু রয়েছে। স্ট্যার্ট আপ নামে মেরিটাইম খাতে দেশের প্রথম ও একমাত্র বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার রয়েছে।