জি ২০ সম্মেলনে ‘গেস্ট অব অনার’

গ্রুপ অব টোয়েনটি ফিন্যান্স মিনিস্টারস অ্যান্ড সেন্ট্রাল ব্যাংক গভনরস (জি ২০) হলো বিশ্বের ২০টি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট বা গ্রুপ। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন সম্পর্কিত নীতি আলোচনার লক্ষ্য নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রুপের সদস্য ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করে। জি ২০ দেশসমূহের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধানগণও গ্রুপের সম্মেলনে তাদের নিজ নিজ দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। সমষ্টিগতভাবে জি ২০-এর অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ পৃথিবীর মোট জাতীয় উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ, বিশ্ব বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ এবং বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা গঠন করে।

২০২০ সালের হিসাবে, এই গ্রুপের ২০ জন সদস্য- আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্পেন এই জোটের স্থায়ী আমন্ত্রিত অতিথি। কানাডার সাবেক অর্থমন্ত্রী পল মার্টিন প্রথম জি ২০ গঠনের প্রস্তাব করেন। বিশ্বের প্রধান ও উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি সম্পন্ন দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ইত্যাদি ছিল জি ২০ গঠনের মূল উদ্দেশ্য।

২০১১ সাল থেকে জি ২০-এর বার্ষিক সম্মেলন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৯-১০ সেপ্টেম্বর, জি ২০ শীর্ষ সম্মেলন (এ ২০ ঝঁসসরঃ ২০২৩) উপলক্ষে দিল্লিতে বসেছে চাঁদের হাট! জি ২০ (এ ২০) বা গ্রুপ অব টুয়েন্টি হলো একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ফোরাম। ১৯৯৯ সালে এশিয়ায় আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ার পর, ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নরদের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও আর্থিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য এই ফোরাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে জি ২০ গোষ্ঠী রাষ্ট্রপ্রধান স্তরে উন্নীত হয়েছিল। অর্থাৎ, শীর্ষস্তরের বৈঠক শুরু হয়। ২০০৯-এ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রধান ফোরামে পরিণত হয় এই গোষ্ঠী। ২০২২-এর ১ ডিসেম্বর থেকে এই গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের দায়িত্বে আছে ভারত।

আগেই বলা হয়েছে, জি ২০ গোষ্ঠী ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই ১৯টি দেশ হলো আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইটালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং অবশ্যই ভারত। আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ প্রায় প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই অংশ নিচ্ছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইতোমধ্যেই জনিয়ে দিয়েছেন যে, বৈঠকে তিনি উপস্থিত থাকতে পারছেন না। ব্যস্ত কর্মসূচি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তিনি আসতে না পারলেও তাঁর জায়গায় বৈঠকে অংশ নেবেন রুশ বিদেশমন্ত্রী ল্যাভরভ।

অন্যদিকে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। শীর্ষ সম্মেলনের ঠিক আগে উসকে উঠেছে চীন-ভারত মানচিত্র বিতর্ক। চীনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি সরকারি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং আকসাই চিনকে তাদের এলাকা বলে দাবি করেছে বেজিং। এই নিয়ে প্রথমবারের মতো সরকারি স্তরে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত।

১৯ দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান ছাড়াও, শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন আরও ৯টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। বাংলাদেশ, মিসর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজিরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ভারতের সভাপতিত্বে অতিথি সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়াও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব শ্রম সংস্থা, ফিন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি বোর্ড, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন সংস্থা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানরাও অংশ নিয়েছেন এই শীর্ষ সম্মেলনে।

এই সংগঠনগুলোর পাশাপাশি আছেন আফ্রিকান ইউনিয়ন, আসিয়ান, আফ্রিকান ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর প্রধানরাও। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সৌর জোট, কোয়ালিশন ফর ডিসাস্টার রেসিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে অতিথি সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। নয়াদিল্লিতে জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক পার্শ্ববৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দুই রাষ্ট্রনেতার ওই বৈঠকে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নানা ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্টের দপ্তর জানিয়েছে। বৈঠকে এবার সভাপতিত্ব করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জি ২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, ‘বৈঠকে বাংলাদেশ এসডিজির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য মতামত তুলে ধরবে। জি ২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বহুপাক্ষিকতা জোরদার করা এবং খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মাদকবিরোধী কার্যক্রম, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তা ছাড়াও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রম এবং লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করার ওপর আলোকপাত করা হবে।’ এছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো হবে। তবে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে মিলিত হওয়া, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করা, এটাই হবে বাংলাদেশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম,
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক- বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোঃ লিঃ