কমিউনিটি ক্লিনিক বিপ্লব ॥ গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা

কমিউনিটি ক্লিনিক বিপ্লব ॥ গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা
০ পাঁচ মাসে সেবা পেয়েছেন ২ কোটি মানুষ
০ ২৯ ধরনের জরুরী ওষুধ সরবরাহ
 
স্টাফ রিপোর্টার ॥ কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল ভোগ করছেন দেশের মানুষ। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রায় দু’কোটি মানুষ ক্লিনিকের সেবা গ্রহণ করেছেন। চালু হওয়ার পর থেকে মোট ১৭ কোটির বেশি রোগী সেবা পেয়েছেন। রেফার করা হয়েছে সাড়ে ৩৪ লাখ রোগীকে। প্রতিটি কমিউনিটি 
ক্লিনিকের সুপারভিশন ও মনিটরিং জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চলছে। আর সিএইচসিপিদের চাকরি স্থায়ীকরণের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ২৯ প্রকারের জরুরী ওষুধ নিয়মিতভাবে সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ২৯ প্রকারের জরুরী ওষুধ নিয়মিতভাবে সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। জনকল্যাণমূলক এই প্রকল্পটিকে ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেয়। প্রকল্পের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করে ফেলে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি আবার চালু করে। এখান থেকে দেশের লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি। সেই সেবাকে জোট সরকার বন্ধ করে দিয়ে দেশে নির্মিত হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক গরু ছাগলের ঘর বানিয়েছিল।
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের পরিচালক, অতিরিক্ত সচিব ডা. মাখুদমা নার্গিস জানান, স্থানীয় পর্যায়ে ফান্ড সৃষ্টি করা হবে। নতুন ২৯৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণাধীন রয়েছে। আর ৬০৬টি ক্লিনিক নির্মাণের জন্য জমি সংগ্রহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সিএইচসিপিদের প্রশিক্ষণ কমিউনিটি গ্রুপ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্বে ৮ হাজার ৮৪৮ জন এবং দ্বিতীয় পর্বে ৪ হাজার ৩৭৭ জন কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপি) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। গ্যাভি-এইচএসএসের অর্থায়নে ও তত্ত্বাবধানে ১৩ জেলার ১ হাজার ৮২১টি কমিউনিটি গ্রুপের ২৩ হাজার ৬৭৩ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আর অন্যান্য সহযোগী সংস্থা/এনজিওর সহযোগিতায় ১ হাজার ৭৯টি কমিউনিটি গ্রুপের ১৪ হাজার ২৭ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ৪৬টি জেলার ৩২৯টি উপজেলার কমিউনিটি গ্রুপের প্রায় দেড় লাখ সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলছে, যা আগামী ১০ জুনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিয়মিত মনিটরিং করলে সাধারণ মানুষ ক্লিনিকের সেবার সুফল ভোগ করতে পারবেন বলে মনে করেন পরিচালক।
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. কেএম আজাদ জানান, স্থানীয় পর্যায়ে ফান্ড সৃষ্টি করা হবে। স্বেচ্ছায় যাঁরা দেবেন, তাদের কাছ থেকেই ফান্ডের টাকা গ্রহণ করা হবে। রোগীদের টাকা দিতে বাধ্য করা হবে না। রোগীদের কেউ দিতে চাইলে তাও গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও জানান, ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেয়ার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়ে থাকে। ক্লিনিকের শতকরা ৯০ ভাগ কাজই হয়ে থাকে সচেতনতামূলক। অনেক ক্লিনিকে ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক ডেলিভারি কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের ২৩২টি ক্লিনিকে এ কার্যক্রম সফলভাবে চলছে। বাকিগুলোতে চালু করার চিন্তাভাবনা চলছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ২৯ প্রকারের জরুরী ওষুধ নিয়মিতভাবে সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। ৪৬টি জেলার ৩২৯টি উপজেলার কমিউনিটি গ্রুপের প্রায় দেড় লাখ সদস্যদের প্রশিক্ষণ গত ১০ জুন সম্পন্ন হয়েছে। 
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোঃ শাহ নেওয়াজ জনকণ্ঠকে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের সব এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে পল্লী এলাকার হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী সেবা পাচ্ছেন এবং উত্তরোত্তর সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সেবা কার্যক্রমকে মানসম্মত ও আরও অধিকতর বেগবান করার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিমাসে অন্তত ২টি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করছেন। বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালক (স্বাস্থ্য), উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালকরা নিজ নিজ বিভাগে প্রত্যেকে প্রতিমাসে অন্তত ২টি করে কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করছেন। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনরা নিজ নিজ জেলায় প্রতিমাসে অন্তত ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করছেন। মেডিক্যাল অফিসার (সিএস) সিভিল সার্জনদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিমাসে অন্তত ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করবেন। প্রোগ্রামার (টিবি ও লেপ্রসি) স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিমাসে ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করছেন। এভাবে জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিমাসে ৪টি, জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক ৪টি, ইপিআই সুপারভাইজার ৬টি ও জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করছেন। 
বর্তমান সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর জোর দিয়েছে। এই ক্লিনিকের আশীর্বাদে বাড়ির পাশেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কমিউনিটি ক্লিনিকে নির্ধারিত ৩০ প্রকারের ওষুধের তালিকা টাঙ্গিয়ে দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি সেবাদানকারীদের করণীয় ‘নির্দেশিকা’ কমিউনিটি ক্লিনিকে দেয়া হয়েছে। নির্দেশিকায় টাঙ্গানো থাকায় চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে অবৈধ কাজ করার সুযোগ থাকছে না। ওষুধ পাচার ও সেবাদানে অবহেলা করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বেশ কিছু ক্লিনিকের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে মনিটরিং জোরাল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। 
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের পরিচালক জানান, রোগীর অবস্থা অনুযায়ী বিতরণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ প্রকারের ওষুধ। ক্যাপসুলের মধ্যে রয়েছে এমোক্সিসিলিন, ডক্সিসাইক্লিন। ট্যাবলেটের মধ্যে রয়েছে এ্যালবেনডাজল, এন্টাসিড, ক্যালসিয়াম ল্যাকটেট, ক্লোরফেনিরামিন, কো-ট্রাইমোক্সাজল, এ্যাজি থ্রোমাইসিন স্টিয়ারেট, ফেরাস ফিউমারেট উইথ ফলিক-এসিড, হাইয়োসিন এন বিউটাইলব্রোমাইড, মেট্রোনিডাজল, প্যারাসিটামল, পেনিসিলিন বি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, জিঙ্ক ডিসপারসিবল। সিরাপ বোতলের মধ্যে রয়েছে এমোক্সিসিলিন, এমোক্সিসিলিন পেডিয়াট্রিক ড্রপ, এ্যাজি থ্রোমাইসিন ড্রাই সিরাপ বেনজাইল বেনজোয়েট, ক্লোরফেনিরামিন, প্যারাসিটামল সাসপেনশন, সালবিউটামল, ক্লোরহেক্সিডাইন এ্যান্ড কেট্রিমাইড সল্যুশন, ক্লোরামফেনিকল আই অয়েনমেন্ট, কম্পাউন্ড বেনজোয়িক এ্যাসিড অয়েনমেন্ট, জেনটিয়ান ভায়োলেট টপিক্যাল সল্যুশন, নিউমাইসিন এ্যান্ড বেসিট্রাসিন অয়নমেন্ট। আরও রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি উপকরণ। 
কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম এবং সেবাদানকারীদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশিকা সম্পন্ন করে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পৌঁছে দিয়েছে সরকার। নির্দেশিকায় টাঙ্গানো থাকায় চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে অবৈধ কাজ করার সুযোগ থাকছে না। নির্দেশিকায় বলা হয়, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি) শুক্রবার এবং সরকারী ছুটিন দিন ব্যতীত প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবেন। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বাস্থ্য সহকারী এবং এফডব্লিউএ-এর কাজে সহায়তা করবেন। হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা ক্লিনিক খোলা এবং বন্ধ করা, রোগীর উপস্থিতি রেজিস্ট্রারে নাম তোলা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিশ্চিত করাসহ তাদের কর্মপরিধির আওতাধীন এই মুহূর্তে যে সকল কর্মকা- পরিচালনা করা সম্ভব তা করবেন। কমিউনিটি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবেন। সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসব পূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসব পরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা দেবেন। সময় মতো প্রতিষেধক টিকাদানসহ (যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশ, পোলিও, ধনুস্টঙ্কার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি) শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। জনগণের জন্য বিশেষ মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেবা প্রদান করা হয়। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা-পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া হাঁপানী চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমন- কনডম, পিল, ইসিপি ইত্যাদি সার্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হবে। জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবা প্রদান করে দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করতে হবে। সদ্য বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের নিবন্ধিকরণ ও সম্ভাব্য প্রসব তারিখ সংরক্ষণ করতে হবে। মহিলা ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা শনাক্ত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ব্যবস্থাদি থাকা সাপেক্ষে স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করা হবে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ওষুধপত্র ও এমএসআরসহ আবশ্যক দ্রব্যাদির প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করবেন। ওষুধপত্র ও এমএসআর সংগ্রহের জন্য ইউনিয়ন মেডিক্যাল অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং পরিবার কল্যাণ সামগ্রী প্রদানের জন্য উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বরাবর ইনডেন্ট প্রদান করবেন। যেসব গর্ভবর্তী মহিলা কমিউনিটি ক্লিনিক হতে প্রসবপূর্বক ও প্রসবোত্তর সেবাগ্রহণ করেননি এবং যেসব নারী/পুরুষ ইপিআই, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তাদে খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন।