ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ নয় জেলায় ভূমিকম্প মানচিত্র, উপকূলীয় এলাকায় নতুন পাঁচ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং দুর্যোগ সময়ে কাজের জন্য লক্ষাধিক স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পদক্ষেপ অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এটি মন্ত্রিপরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হবে। কর্মযজ্ঞের অংশ হিসেবে কয়েক বছরের ভূমিকম্পন মাত্রা বিশ্লেষণ করে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সিলেট ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঝুঁকি সংক্রান্ত মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে এখন টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীর ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরির কাজ চলছে।
সূত্র জানায়, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন ২০০৯-২০১১ সালে প্রায় ৬৩ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং সিটি করপোরেশনগুলোকে প্রদান করেছে। বর্তমানে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজে আরও ১৫৮ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করার বিষয় প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার জন্য ১২টি জরুরি মোটরগাড়ি এবং ছয়টি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় করা হয়েছে। ২৫টি ছোট সি বোটও কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির মাধ্যমে ৪৯ হাজার ৩৬৫ জন স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা হচ্ছে, যার এক-তৃতীয়াংশ নারী। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ও সিডিএমপির সহায়তায় আরও ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। ২২ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের প্রশিক্ষণ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী উপকূলীয় অঞ্চলে ৫০০০ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ৩ হাজার ৭৫১টি আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও আরও ১০০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং দেশের ৯ জেলায় ৫৫৬টি নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত অপর্যাপ্ত সুবিধাসংবলিত ৪৫০ শেল্টার পুনর্নির্মাণ ও শেল্টারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে ৫৫০ কিলোমিটার সংযোগকারী সড়ক নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করা হবে। এ কাজে সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক ৩৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার দেবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন জানিয়েছেন, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ সফলভাবে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের একটি ক্রমবর্ধমান নেটওয়ার্ক এবং কমিউনিটিভিত্তিক আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করেছে, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জীবন ও সম্পদ রক্ষা করছে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) উপকূলীয় এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্রের মেরামত ও অতিরিক্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ওপর জোর দিয়েছে। দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ঝুঁকি কমিয়ে আনার ব্যবস্থা উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, খরা, কালবৈশাখী, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দুর্যোগের কোনো কোনোটি প্রায় প্রতিবছরই আঘাত হানছে। ভৌগোলিক অবস্থান, অধিক জনসংখ্যা এবং দরিদ্রতা দুর্যোগের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া দেশের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলসহ ঢাকা মহানগরী ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় এরই মধ্যে সরকারের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দরিদ্রদের জন্য ৪০০০টি ঘূর্ণিঝড় সহনীয় দালান ঘরসহ ৬ হাজার ১৮৬টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামীণ রাস্তায় জলাবদ্ধতা দূর এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে সমতল ভূমিতে ৩ হাজার ১৭৫টি এবং পার্বত্য এলাকায় ৩৭২টি মিলিয়ে ৩ হাজার ৫৪৭টি ছোট ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সমতল ভূমিতে আরও ১ হাজার ৩৮৩টি এবং পার্বত্য এলাকায় ১৩৫টি মিলিয়ে ১ হাজার ৫১৮টি ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্য প্রচারে মোবাইল ফোন প্রযুক্তি, কমিউনিটি বেতার বার্তা ব্যবস্থাসহ নানা পরিকল্পনা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।