সমবায়ে ‘স্বপ্ন চাষ’

সমবায় সমিতি করে নিজের ও পরিবারের উন্নয়ন করছেন রংপুর সদর উপজেলার চন্দনপাট ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের অতিদরিদ্র নাগরিকরা। এর মাধ্যমে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবন। যেন সমবায়ে ‘স্বপ্ন চাষ’ করছেন তারা। সমবায় সমিতির তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে সুদবিহীন ঋণ নিয়ে হাতের কাজ করে স্থায়ী সুখ ফিরে এসেছে শতাধিক অতিদরিদ্র পরিবারে। তাই সমবায় সমিতির সদস্যরা বলছেন, তাদের ৯নং ওয়ার্ড সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি ‘সুখের গোপন ঠিকানা’।

জানা গেছে, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি তার উপজেলার একটি ওয়ার্ডকে বেকারমুক্ত, ডিজিটাল ও শতভাগ কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বপ্ন দেখতেন। এজন্য চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের অতিদরিদ্র পরিবারগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে নারীদের নিয়ে কয়েকটি সমাবেশ করেন তিনি। সমাবেশে উদ্দীপ্ত বক্তব্যে সুফল আসা শুরু করলেও অতিদরিদ্র পরিবারগুলোকে সমবায়ে সংগঠিত করার মতো সংগঠক খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। উপজেলার সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে ফরিদ উদ্দিন সরকার ২০১৫ সালে যোগদানের পর নাছিমা জামান মনের ভেতর চেপে রাখা স্বপ্নটি তাকে খুলে বলেন। বেকারমুক্ত, প্রযুক্তিবান্ধব ও শতভাগ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ওই ৯নং ওয়ার্ডকে বেছে নিয়ে বেজলাইন সার্ভে করার পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের আওতায় ‘নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন’ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে ফরিদ উদ্দিন সমবায়ভিত্তিক ‘ডিজিটাল ওয়ার্ড গঠন, নেটওয়ার্কিং সক্ষমতা তৈরি ও দারিদ্র্যবিমোচন’ শিরোনামে একটি ইনোভেশন প্রকল্প আইডিয়া তৈরি করেন। নাছিমা জামান আইডিয়াটিকে কার্যকর ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। পরে বেছে নেওয়া হয় চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডকে। নাছিমা জামান তথ্য সংগ্রহ করার সুবিধার্থে শুরুতে একটি ল্যাপটপ প্রদান করেন। পরে পরিষদের ফান্ড থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। প্রাথমিকভাবে সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কম্পিউটার, থ্রেসার মেশিন ও সেলাই মেশিন ক্রয় করা হয়। শুরু হয় পথচলা। ৯নং ওয়ার্ডে ১১০ নারী ও পুরুষকে সমবায় সমিতির সদস্য করা হয়। কাগজের ঠোঙা তৈরি, পাট থেকে বেনি তৈরি, ধান মাড়াইয়ের জন্য থ্রেসার মেশিন চালানো, মধু উৎপাদন ও মধু সংগ্রহ, বেতিপুথি, ক্রিস্টাল, শোপিস ও কাপড়ের ওপর নকশা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সদস্যরা সঞ্চয় দিতে গড়িমসি করলে উপজেলা চেয়ারম্যান নিজের নামে ১ হাজার টাকা সঞ্চয় দিলে বাকি সদস্যরা উৎসাহী হয়ে মাসিক ১০০ টাকা করে সঞ্চয় জমা প্রদান শুরু করেন। সদস্যদের জমা রাখা ওই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের টাকার সঙ্গে উপজেলা পরিষদের ফান্ড থেকে দেওয়া বরাদ্দকৃত টাকার সমন্বয় ঘটিয়ে সদস্যদের কাগজের ঠোঙা তৈরির জন্য কাগজ, পাটের বেনি তৈরির জন্য পাট, সেলাই করার জন্য সেলাই মেশিন, মধু সংগ্রহের জন্য বক্স বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। এছাড়া এক সেলুন ব্যবসায়ীকে উপকরণ কেনার জন্য, এক নারী উদ্যোক্তাকে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য, এক মুরগি ব্যবসায়ীকে ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য, এক সাইকেল মেকারকে ঘর নির্মাণের জন্য সমবায় সমিতি থেকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হয়। দিনবদলের যুদ্ধে নামেন চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের অতিদরিদ্র নারী-পুরুষরা। ধান মাড়াইয়ের থ্রেসার মেশিনের আয়, কাগজের ঠোঙা, পাটের বেনি বিক্রির আয়ের সঙ্গে তাদের দেওয়া সঞ্চয় এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক লাখ টাকায়। ক্রমেই বদলে যাচ্ছে তাদের কষ্টকর অতিদরিদ্রতায় ভরা জীবন। শুরু হয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার দৌড়। চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার বাস্তবতা দেখে অন্য ওয়ার্ডের অতিদরিদ্র নারী-পুরুষ তাদের ওয়ার্ডে প্রকল্পটি চালুর দাবি করছেন।
সরেজমিন কিছু সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। রাবেয়া বেগম নামে এক সদস্য জানান, আমাদের সমবায় সমিতি আমাদের স্বপ্ন। আমি পরিবারের কাজে সময় দেওয়ার পর বাকি সময়টুকু পাটের বেনি তৈরি করি। প্রতি গজ বেনি ১ টাকা দরে বিক্রি হয়। ২ ঘণ্টায় ১০০ বেনি তৈরি করি। মাস শেষে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করা শিখেছি। সমিতির কার্যক্রম সচল থাকলে টাকা-পয়সা জমিয়ে মধ্যবিত্ত জীবনে প্রবেশ করা সময়ের ব্যাপার। সাইকেল মেকার আবেদ আলী বলেন, এনজিওর টাকায় বছর শেষে লাভ দিতে হয়। আমি ৯নং ওয়ার্ড সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। মাসে মাসে সুদ ছাড়াই ঋণ পরিশোধ করছি। আমার স্ত্রী বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করছেন। দুই মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে এসে অবসর সময়ে কাগজের ঠোঙা তৈরি করছে। পরিবারের ব্যয় মিটিয়ে এখন প্রতি মাসে জমাতে পারছি ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। মৌমাছি থেকে মধু সংগ্রহ করা শিখেছে সমিতির সদস্য নুরুল হক। তিনি বলেন, সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়, জানতাম না। সমিতি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তারা মৌমাছি রাখার বাক্সও দিয়েছিল। প্রথমে বাড়ির পাশে মধু সংগ্রহ করতাম। এখন বগুড়া, পঞ্চগড় যেখানে ফুল আছে, সেখানে গিয়ে মৌমাছি থেকে মধু সংগ্রহ করি। হাতের কাছেই টাকা ছিল, জানতাম না। ১ কেজি খাঁটি মধু ৫০০ টাকায় বিক্রি করি। অভাব পালাইছে বাহে।
এছাড়া এ সমবায় সমিতির মাধ্যমে সমবায়ীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি, অকৃষি, আর্থিক ও সেবা খাতে টেকসই সমবায় গড়ে তোলা এবং ডিজিটাল তথ্যভিত্তিক ওয়ার্ড গঠনে নেওয়া হয় পদক্ষেপ। এক সিলিপের তালিকায় নিয়ে আসা হয় ওয়ার্ডের কৃষক, ভূমিহীন, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, জেলে, এতিম ছেলেমেয়ে, শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণী, বিধবা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, কিশোর-কিশোরী, গর্ভবতী নারী, অতিদরিদ্র পরিবার ও বর্গাচাষিদের পরিসংখ্যানের সঠিক তথ্য। সংগ্রহ করা তথ্যগুলো প্রতি মাসে আপডেট করা হয়। নাগরিকদের সেবা প্রদানের রকম জানাতে স্থাপন করা হয়েছে ‘ডিজিটাল ওয়ার্ড উন্নয়ন তথ্যকেন্দ্র।’ যে কোনো দানশীল ব্যক্তি, জিও, এনজিও অথবা সরকারের যে কোনো সাহায্য-সহায়তা কিংবা বরাদ্দ সমবণ্টনের জন্য ওই ওয়ার্ডের যে কোনো তথ্য ডিজিটাল ওয়ার্ড উন্নয়ন তথ্যকেন্দ্রে গেলে সহজেই পাওয়া যাবে। এভাবেই তথ্যভিত্তিক ওয়ার্ড গঠন, উৎপাদনমুখী কর্মকা- বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে একটি ছোট ওয়ার্ড থেকে প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ ও দারিদ্র্যবিমোচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সার্বিক উন্নয়ন ডিজিটাল গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি। চন্দনপাট ইউনিয়নের ওয়ার্ডভিত্তিক সার্বিক উন্নয়ন ডিজিটাল গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির সাফল্যের কথা শুনে পরিদর্শনে আসেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক, রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ, সাবেক জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, উপজেলা চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন সরকার, চন্দনপাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান প্রমুখ।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, এই এগিয়ে চলার পেছনের গল্পের নায়ক নাছিমা জামান ববি। তার অনুপ্রেরণায় ও নিবিড় পরিচর্যায় এতদূর আসতে পেরেছি। একটি ওয়েবসাইট তৈরির কাজে হাত দিয়েছি। ওই ওয়েবসাইটে গেলেই সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সব তথ্য পাওয়া যাবে, যা চিহ্নিত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এ ব্যাপারে নাছিমা জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাংলাদেশ একদিন উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে। আমার উপজেলার চন্দনপাট ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের অতিদরিদ্র মানুষকে নিয়ে সমবায় সমিতি গড়ে তুলে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, এ উদ্যোগের সফলতা ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।