কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশের সেনা

২৬ বছরের অংশীদারিত্ব, আছেন ছয় হাজারেরও বেশি সদস্য

কুয়েত পুনর্গঠনে ২৬ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুয়েতের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এরপর থেকে বাংলাদেশ ও কুয়েত সরকারের মধ্যে ‘অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন’ নামের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ২৬ বছর ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ১০ বছর ধরে কুয়েতের শ্রমবাজার বন্ধ থাকলেও সেনাবাহিনীর হাত ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের দক্ষ বেসামরিক পেশাজীবীরা কুয়েতে যাচ্ছেন। বর্তমানে ছয় হাজারের বেশি সেনাবাহিনীর সদস্য কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ থেকে আরও এক হাজার সেনাসদস্য নিয়োগের অনুমোদন হয়ে আছে। ফলে কুয়েতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এ বছরই সাত হাজার ছাড়িয়ে যাবে। কুয়েত কোস্টগার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন ১১৮ জন নৌবাহিনীর সদস্য। এ সংখ্যাটিও এ বছরই ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুয়েতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, মাইন অপসারণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকি বাহিনী কুয়েত দখলকালে কুয়েতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। কুয়েতের ঐতিহ্যের স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেয় তারা। গুরুত্বপূর্ণ তেল ক্ষেত্রগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই ক্ষতচিহ্ন মুছে আধুনিক কুয়েত বিনির্মাণে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অবশ্য কুয়েত সিটির আধুনিকায়নের আড়ালে যুদ্ধের স্মৃতি চোখেই পড়বে না। সেগুলো তারা জাদুঘরে পাঠিয়েছে। সেই জাদুঘরে কুয়েতকে সহযোগিতার নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশকে তারা গুরুত্বসহকারে জায়গা দিয়েছে। করেছে বাংলাদেশ কর্নার। সেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কুয়েতের তৎকালীন আমিরের ছবি। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের ছবি। আছে বাংলাদেশি এক সেনাসদস্যের পূর্ণ অবয়বের স্থাপনা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে অন্তরে ধারণ করে রেখেছে কুয়েত।

কুয়েত সফরকারী প্রতিরক্ষা ডেলিগেশনের সদস্যরা বুধবার দুপুরে জাদুঘরের বিভিন্ন স্থানও পরিদর্শন করেন। জাদুঘরে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত স্থানে একটি বড় আকারে বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের ম্যাপ এবং বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের সেনাক্যাম্পের ম্যাপও স্থান পায়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল পোশাক এবং নিহত কয়েকজন সেনাকর্মকর্তার ছবি বোর্ডে স্থাপন করা হয়েছে। অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠনে নিয়োজিত বাংলাদেশি সেনাসদস্যরা কুয়েত সেনাবাহিনীর পোশাক পরেন। তাদের সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা, পদমর্যাদা পান তাদের মতোই।

কুয়েতি সেনাদের প্রশিক্ষণ দেবে বাংলাদেশ : কুয়েত আর্মড ফোর্সের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ খালেদ আল  খেদের কুয়েতি সেনাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণে পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে ১৫ জন কুয়েতি সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। গত মঙ্গলবার কুয়েত সফররত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠককালে তিনি এ আগ্রহ প্রকাশ করেন। কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুহাম্মদ ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, মাহমুদ সামাদ চৌধুরী, মো. মাহবুবুর রহমান প্রতিনিধি দলে অংশ নেন। কুয়েতের চিফ অব স্টাফ বলেন, এখানে ৬০০০ বাংলাদেশি সেনাসদস্য নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

মাইনফিল্ডে জীবনবাজির ঝুঁকি : ১৯৯১ সালে ইরাক কুয়েত দখলের সময় কুয়েতের প্রায় ৬০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে মাইনসহ ভারী অ্যামুনেশন (গোলাবারুদ) ডাম্প করে রাখে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা কুয়েতের বিস্তৃত মাইনফিল্ডে জীবনবাজির ঝুঁকি নিয়ে ২০০২ সালের মার্চ থেকে মাইনসহ ভারী যুদ্ধাস্ত্র অপসারণের কাজ শুরু করে। গত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাইনক্ষেত্রের বিস্তৃত এলাকার অ্যামুনেশন ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। বুধবার ভোরে কুয়েত সিটি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে উম্মুলগতি ডেমোলেশন প্রজেক্ট মাইনফিল্ড পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয় সফররত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির ডেলিগেটদের। সেখানে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তারা ডেলিগেট সদস্যদের ব্রিফ করেন। মাইনফিল্ডে অ্যামুনেশন চিহ্নিত করা, নিষ্ক্রিয় ও ধ্বংস করার কাজটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৬ সালে লে. করপোরাল জয়নাল আবেদীন নামের এক সেনাসদস্য মাইনফিল্ডে কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান। গত বছরও একজন মারাত্মক আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্ধারিত এলাকার প্রতি ইঞ্চি জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে মাইন অপসারণের কাজটি করছে। সেখানে স্থল মাইনের পাশাপাশি রকেট লঞ্চার, আর্টিলারি সেল, মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারসহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস করা হয়। সেনাসদস্যরা এ পর্যন্ত ৮০০০ টন গোলাবারুদ নিষ্ক্রিয় ও ধ্বংস করেছে বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।   কুয়েতে বাংলাদেশ মিলিটারি কন্টিনজেন্টের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম উজ জামান বলেন, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এখানে আস্থা ও মর্যাদার সঙ্গে অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজ করছে। কুয়েতের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত কুয়েত ন্যাশনাল গার্ডেও আমাদের সদস্যরা শিগগিরই যোগ দেবে। চলতি বছর আরও এক হাজার সদস্য মোতায়েন হলে এখানে আমাদের ফোর্স সংখ্যা বেড়ে সাত হাজার অতিক্রম করবে। তিনি বলেন, কুয়েতের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের তরুণ সামরিক কর্মকর্তা, নন-কমিশন অফিসার ও সেনাদের বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ দিতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে।

লেবানন এবং কুয়েত সফর শেষে  দেশে ফিরেছে  প্রতিনিধি দল : দশম জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন লেবানন এবং কুয়েতে সাত দিনের সফর শেষে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছে। বিমানবন্দরে তাদের অভ্যর্থনা জানান সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান।