বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বাড়ছে

পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের নেওয়া নানামুখী কাজের অগ্রগতি দেখে বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশের অন্যতম এই রপ্তানি খাতের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর তথ্যে জানা যায়, এরই মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি দেশের পার্লামেন্ট সেক্রেটারি পর্যায়ের প্রতিনিধি এসে বাংলাদেশের পোশাক খাতে সাম্প্রতিক অগ্রগতি দেখে গিয়েছেন। আর গত তিন মাসে এই খাতে রপ্তানি আয়ের বৃদ্ধিই প্রমাণ করে যে, বিদেশি ক্রেতাদের পোশাক খাতের প্রতি আস্থা আবার ফিরে আসছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক খাতে ইতিবাচক সংস্কারের ফলে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই ১৬ মাসে দেশে পোশাক কারখানায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিদেশিদের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশের পোশাক খাতের গৃহীত উন্নতির কথা স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এ ছাড়া রানা প্লাজা ভবন ধসের তিন বছর পরে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদন ও গবেষণাতেও দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠে। বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দাতা সংস্থা, অংশীদারের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতও এই বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বিজিএমইএর কর্মকর্তাদের তথ্যে, শ্রমিকদের নিরাপত্তায় এখন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। কারখানার কর্মপরিবেশ পরিদর্শনে এখন পর্যন্ত ২৭৭ জন পরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও ১৬৪ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। শ্রমিকদের তথ্য সংরক্ষণে কারখানাগুলোতে ডাটাবেজ তৈরি করছেন মালিক পক্ষ। কারখানাগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে ডাটাবেজ তৈরির জন্য মালিকদের বলা হয়েছে। এরই মধ্যে ১ হাজার ২০০ কারখানা শ্রমিকদের সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এ ছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয় পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকারের কাছে কর্মপরিবেশ সংক্রান্ত অভিযোগ দেওয়ার জন্য বিনামূল্যে হেল্পলাইন সুবিধা চালু করেছে। ০৮০০-৪৪৫৫০০০-এই নম্বরে শ্রমিকরা ফোন দিয়ে যে কোনো অভিযোগ জানাতে পারবেন। এমনকি বাংলাদেশে তৈরি পোশাককে বিশ্ব দরবারে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশীয় পোশাক উদ্যোক্তারা এখন পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা নির্মাণে আগ্রহী। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে এবং বিদেশি ক্রেতাদের আকর্ষণে উদ্যোক্তারা পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হচ্ছেন। বিজিএমইএর তথ্য— এরই মধ্যে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার স্বীকৃতি হিসেবে দেশের ২৮টি কারখানা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের লিড সনদ পেয়েছে। আরও ১১৮টি কারখানা এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া পোশাক কারখানায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় ‘অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ’ নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নিচ্ছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। এ জন্য এখন শ্রমিকদের ট্রেনিং চলছে। এ ছাড়া কারখানাগুলোয় প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের জন্য হুইল চেয়ার ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।  ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ‘তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন : অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর এই খাতের পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে ৭৭% উদ্যোগের উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই সময়ে শ্রমিকদের উন্নয়নে বিভিন্ন শ্রম আইন পাস করা হয়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ৯৫ শতাংশ কারখানায় মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে নির্ধারিত মজুরি দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ কমপ্লায়েন্স কারখানায় শ্রমিকদের জরুরি নম্বরসহ পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে ‘সিপ’ প্রজেক্টের আওতায় ৪৩ হাজার ৮০০ জন শ্রমিককে প্রশিক্ষণ ও অন্য আরও প্রকল্পের আওতায় নিয়মিত অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে ক্রাশ কোর্স পরিচালনা হচ্ছে। ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও মার্কিনদের অ্যালায়েন্স কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রায় শতভাগ কারখানায় জরিপ শেষ করেছে এবং জরিপ পরবর্তী রেমিডিয়েশনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য (প্রায় ৪৪%) অগ্রগতি হয়েছে। বিজিএমইএ-র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাক খাতের সংস্কারে আমরা যে কাজগুলো করছি তা দেখে আমাদের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর পোশক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধারে প্রতিটি কারখানার ইন্সপেকশন শুরু করি। ত্রুটি থাকায় ৩৯টি কারখানা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে পোশাক কিনছেন, তাদের বাংলাদেশে অফিস বা এজেন্ট আছে। তারা সব সময়ই কারখানাগুলো পরিদর্শন করছেন। ক্রেতারা দেখছে আমরা গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। এরই মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি দেশের পার্লামেন্ট সেক্রেটারি পর্যায়ের প্রতিনিধি এসে আমাদের অগ্রগতি দেখে গিয়েছেন। আশা করছি এই বছরের মধ্যেই শতভাগ কমপ্লায়েন্ট অর্জন করতে পারব। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ‘রি-ইমার্জিং ফ্রম দ্য রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : অ্যান অ্যাকাউন্ট অন দ্য থার্ড অ্যানিভার্সারি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়, কারখানাগুলোর বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে এ খাতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পরিদর্শকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত তিন বছরে পোশাক খাতের সংস্কারে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করতে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়। সিপিডির এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, প্রথমদিকে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কাজ সম্পর্কে ধারণা করতে না পারলেও এখন আমরা তাদের কার্যকারিতা বুঝতে পারছি। তিনি বলেন, ব্যবসার জন্য সংস্কার কাজ ভালো। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়ার জন্য মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তবে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব মিকাইল শিপার জানান, পোশাক খাতের উন্নয়ন ও সংস্কারে শ্রমিক, মালিক, সরকার ও সামাজিক সংগঠন সবাই মিলে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই মধ্যে ৩৫০টি নতুন ট্রেড ইউনিয়ন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো যে কারখানাগুলো ভাড়া ভবনে চলছে সেগুলোর সংস্কার কাজ মনিটরিং করা চ্যালেঞ্জের।