চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারদর্শী

আমাদের সমস্ত জাতীয় সমস্যার সমাধান আমরা তখনই করতে পারব যখন আমরা দক্ষ ও সৎকর্মী হব, শান্তভাবে, নিঃশব্দে ও ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাব। যারা মনে করে কাজে অনেক প্রেরণা চাই, অনেক হৈচৈ চাই তারা না জানে কর্মবিজ্ঞান, না জানে কর্মকৌশল। যে নিঃশব্দে কাজ করে দেখা যায় তার কাজই সব থেকে ভালো হয়। যিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে জানেন তার কাজ কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে না। তিনি রাষ্ট্রনায়কই হন বা সাধারণ মানুষই হন সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। আমাদের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এমনই একজন কর্মবীর যিনি ধৈর্যের সঙ্গে দক্ষতার মিশ্রণে কর্মসম্পাদন করেন কারও সমালোচনার কান না দিয়ে নিজের কাজটি নিজের মতো করে যাচ্ছেন নীরবে-নিভৃতে। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তার কাজে সকলেই সন্তুষ্ট হবে এমনটি নয়। একজন মানুষের পক্ষে সকলকে সন্তুষ্ট করা বা খুশি করা সম্ভব নয়।

শেখ হাসিনা তার কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন সদিচ্ছা থাকলে ভালো কিছু করা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তিনি ঝড়ের কবলে পড়েছেন অনেকবার লন্ডভন্ড হয়েছে তার জীবনচিত্র। বিপন্ন দিন পার করেছেন, কিন্তু কখনো ভেঙে পড়েননি, পরাশক্তির হুমকি মোকাবিলা করে বিপুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে রাজনীতির নৌকা বেয়ে চলেছেন। আত্মবিশ্বাস যে জাতীয় প্রতিষ্ঠার মূল সেটা তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। তার প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসই তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। টানা চতুর্থবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। রাজনৈতিক টর্নেডো মোকাবিলা করে তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক নির্মম ঘটনার ২১ বছর পর। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্থপতি স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতাকেই বিপর্যস্ত করা হয়েছিল। মুজিব পরিবারে সদস্য শেখ হাসিনা ও রেহানা সে সময় বিদেশে অবস্থান করছিলেন বলেই প্রাণে বেঁচে যান। সেই বেঁচে যাওয়াটাই বাংলাদেশ বেঁচে যাওয়া এ ইতিহাস সকলেই জানেন। সারা পৃথিবীই জানে। মূলত বাঙালির ভাগ্যাকাশের এমন উত্থান-পতন যেন পূর্ব নির্ধারিত ছিল। শেখ হাসিনা রাজনীতির সমরাঙ্গনে নিজেকে সদা ব্যস্ত রেখেছেন বলেই এমন সাফল্যের মুখ দেখতে পেয়েছে বাঙালি জাতি। ক্ষমতায় যাওয়াটা রাজনৈতিক কৌশল। সে কৌশলে তিনি শতভাগ সফল। তিনি বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে তারা আরাম চায়, সুখ চায়, সম্পদ চায়, নাইট ক্লাব ছেড়ে কেউ সৎকর্ম যুদ্ধে নামতে চায় না।

এই অধোগতি যখন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশের লোকদের আক্রমণ করে তখন গোটা কাঠামোটাই ভেঙে পড়ে। উল্লেখ্য, একটিমাত্র বৈদেশিক আক্রমণে গোটা রোমান সমাজ টুকরা টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। সেই অবস্থা থেকে আর উঠতে পারেনি। রোমান সাম্রাজ্যের এটা হচ্ছে এক ট্র্যাজেডি। ইজিপ্ট (মিসর) ব্যাবিলোনিয়া, আসিরিয়া প্রভৃতি সাম্রাজ্যও একই রকম পতনপর্বের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের অনেক চিন্তাবিদ সবিস্ময়ে ভাবতে থাকেন, ইউরোপও এমনই একটা পর্বের মধ্য দিয়ে চলছিল কি না। ইউরোপীয় সভ্যতা নিয়ে ইউরোপে বিংশ শতকে প্রথমে যে বইটি প্রকাশিত হয় তার নাম The Decline of the west (পাশ্চাত্যের পতন)। লেখক জার্মান দার্শনিক পন্ডিত অসওরাল স্পেংলার (১৮৮০-১৯৩৬)। ওই প্রন্থটিতে খুব জোরালো ভাষায় তিনি বলেছিলেন, পাশ্চাত্য সমাজ তার দায়িত্ব পালন করে ফেলেছে। এখন সে পতনের পথে। কিন্তু In Defence of the west (পাশ্চাত্যের সমর্থনে) গ্রন্থের লেখক ফ্রান্সের হেনরি ম্যাশোর মতো কিছু রক্ষণশীল ব্যক্তি সে কথা মানেননি। তাদের মনে হয়েছিল যে, তারা তখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। কারণ তাদের অধীনে ছিল অনেকগুলো উপনিবেশ। তারপর এলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, যা ছিল আরও ভয়ংকর। পাশ্চাত্যে নতুন চিন্তা ঢুকেছে তাদের সংস্কৃতির ঘাটতি প্রসঙ্গ নিয়ে। অত্যধিক সংস্কারহীন বস্তুতান্ত্রিকতা এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদা আসলে এক উৎকৃষ্ট সমাজ-সমস্যার ইঙ্গিত। এসব কারণে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার পতন নিয়ে আরও নতুন নতুন গ্রন্থ লিখিত হচ্ছে। পাশ্চাত্য এই সভ্যতা সম্পর্কে শেখ হাসিনা যথেষ্ট প্রাজ্ঞবান বলেই তিনি বাঙালি সভ্যতার পতন দেখতে চাননি।

বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী দীর্ঘকাল বাঙালি জাতি তার সংস্কৃতির পতন ধীরে ধীরে দেখে আসছিল। সে জায়গা থেকে উত্তরণের কোনো পথ যেন খুঁজে পাচ্ছিল না। শেখ হাসিনা সেই পথের সন্ধান দিয়েই দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আজ দেশটি একটি জায়গায় উপনীত হয়েছে। শেখ হাসিনা যেটা ভাবেন সেটা করে দেখান। তিনি দেখিয়েছেন সেটা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশ চালাতে গিয়ে তিনি নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। বিশেষত গত ১৫ বছরে অসাধারণ উন্নয়ন হয়েছে দেশের। কোভিডকালীন অবস্থা সামাল দিয়েছেন নিজ হাতে। বিগত তিনটি বছর সারাবিশ্বেই চলছিল অর্থনৈতিক মন্দা।

অনেক দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। এক শ্রেণির মানুষ কষ্টে আছে সেটা শেখ হাসিনা নিজেও জানেন। ভোগ্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে কেউ কেউ পিষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজটি নিঃশেষ হতে চলেছে। এ বিষয়গুলো শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন। তিনি বিশ^াস করে যাদের কাজের দায়িত্ব দেন তাদের কেউ কেউ বিশ^াস ভঙ্গ করেছেন আবার কেউ কেউ বিশ্বসের মর্যাদা রেখেছেন। আওয়ামী লীগ একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। এ দলে ভালো-মন্দ থাকবেই। তবে দলে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার প্রতি যথেষ্ট আস্থা রেখে ত্যাগ স্বীকার করে দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তারাই মূলত শেখ হাসিনার সাহস শক্তির উৎস। কিন্তু কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নামকরা অনেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে দুর্নীতির। কিছুদিন আগেও যাদের দু’বেলা খাবার জুটত না তারা হয়ে গেছেন কোটিপতি।

কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতা দলের জন্য অপরিহার্য নন, এলাকায় তাদের কোনো জনপ্রিয়তাও নেই। সাধারণ মানুষের কাছে কালপ্রিট হিসেবে চিহ্নিত অথচ শেখ হাসিনা তাদের দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে রেখেছেন। এটা তার রাজনৈতিক কৌশল। সময়মতো আবার তাদের ছুড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করবেন না। এটা অতীতে দেখা গেছে। দলের ভেতর মোশতাকচক্র এখনো বিদ্যমান, সেটাও তিনি জানেন। জানেন বলেই সতর্ক অবস্থানে থেকে টিকে আছেন। তিনি কীভাবে বিদেশীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিএনপি ও তাদের দোসরদের বাদ দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন সেটা ভাবনার বিষয়। তিনি দেশপ্রেমিক ও সাহসী বলেই এটা করতে পেরেছেন। অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বটে, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়নি। গণতন্ত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে কোনো সরকার নেই। যদিও শেখ হাসিনাই এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি তুলে তা প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা ছিল খুবই তিক্ত ও নিষ্ঠুর। জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না তত্ত্বাবধায়কের। তত্ত্বাবধায়কের যুগ শেষ। আজকের বাস্তবতায় শেখ হাসিনা যে পথ অনুসরণ করেছেন তা যথার্থ।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যরা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ। তাই তিনি আমেরিকার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেই রাজনীতি করে আসছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে তার পেছনে কোন দেশটির হাত রয়েছে সেটি শেখ হাসিনা ভালোভাবেই জানেন। তাই সদাসতর্ক রয়েছেন তিনি। ভারসাম্যের কূটনীতির পথ কতটা পিচ্ছিল সেটা শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো কে জানে? বলতে হবে তিনি সে পথটায় পিচঢালায় মনোযোগী হবেন তাতে সন্দেহ নেই। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রেরই নজর রয়েছে। ভূ-রাজনীতির কৌশলটা দেশপ্রেমিক না হলে বোঝা খুবই কঠিন। শেখ হাসিনা সে কৌশল জানেন এ বিশ্বাস রয়েছে আমাদের।

শেখ হাসিনার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো মোকাবিলা করেই তাকে বাংলাদেশ পরিচালনা করতে হবে। সবচেয়ে বড় হচ্ছে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়নমূলক কাজ করতে হবে। তিনি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। তিনি জানেন নবপ্রগতির পথে কীভাবে আপন অবদান রেখে যেতে হয়।

লেখক : ফনিন্দ্র সরকার
রাজনৈতিক বিশ্লেষক