যোগাযোগ খাতে কক্সবাজার রেলপথ

কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের অন্যতম আকর্ষণ এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝিনুক আদলের প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুটের দেশের প্রথম আইকনিক ৬ তলা রেলস্টেশনে আবাসিক সুবিধা থেকে শুরু করে ক্যান্টিন, লকার, টিকিট কাউন্টার, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশু যতœ কেন্দ্র, মসজিদ, পোস্ট অফিস, টুরিস্ট বুথ, কনভেনশন হলসহ ১৭টি বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সুবিধা

পর্যটননগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ সারাদেশের পর্যটকদের চাওয়া ছিল আরামদায়ক, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, যুগোপযোগী ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও রেলযোগাযোগের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হোক। কিছুটা ধীরে হলেও রেলযোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতুর ওপর রেললাইন, আখাউড়া-ভারতের আগরতলার সঙ্গে আন্তঃদেশীয় রেললাইন সম্প্রসারণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার রেললাইনের সংযুক্তি যেমন দেশের মানুষকে ভ্রমণ ঝুঁকি এড়িয়ে আনন্দদায়ক ভ্রমণের সুযোগ দেবে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক ও পর্যটন শিল্পের উন্নতিও ত্বরান্বিত করবে।

আগে যেখানে শুধু চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের ১৫০ কিমি যেতে যানজট এড়িয়ে সড়কপথে ৫/৬ ঘণ্টার বেশি সময় লাগত, এখন আরও দিগুণ দূরত্বের রাজধানী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার যেতে সর্বোচ্চ ৬ ঘণ্টা সময় লাগবে। কক্সবাজার রেলপথের কারণে যাতায়াতের ক্ষেত্রে দৈনিক ৪/৫ ঘণ্টা কমে যাওয়ার ফলে কক্সবাজারের উল্লেখযোগ্য শিল্পপণ্য যেমনÑ শুঁটকি, লবণ, চিংড়ি, সবজিসহ অসংখ্য পচনশীল ও কৃষিজ পণ্য দ্রুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পৌঁছে যাবে। ফলে, সাধারণ কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করে রপ্তানি খাত চিংড়ি শিল্পে কক্সবাজার উপকূলে স্থাপিত অর্ধশতের বেশি হ্যাচারি থেকে প্রায় এক হাজার কোটি চিংড়ি পোনা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলার প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমিতে পৌঁছে যাবে সহজে।
রেললাইনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি পর্যন্ত ৪৭ কিমি রেললাইন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী বিভিন্ন সরকারের অধীনে প্রায় ৫৩ বছর পার হয়েছে কক্সবাজারকে রেললাইনের আওতায় আনতে। ইতিহাস মতে, কক্সবাজারে প্রথম ১৮৯০ সালে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, যা মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত হওয়ার কথা। পরবর্তীতে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে গড়ে ওঠেনি।
বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের আওতায় ২০১১ সালে কক্সবাজার রেললাইনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময়ে ১১০ জন বিদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫০ জন প্রকৌশলীসহ প্রায় ছয় শত লোকের পরিশ্রমে এই কাজ সম্পন্ন হয়। করোনাকালীন সময়ে সারাবিশ্ব যখন স্থবির ছিল, বিশের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে যখন ছিল স্থবিরতা, তখনও সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার রেললাইনের কাজ এগিয়ে গিয়েছিল।
প্রথমে দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম পর্যন্ত প্রায় ১২৯ দশমিক ৪৮ কিমি সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ নির্মাণ প্রকল্প ছিল। যাতে করে বাংলাদেশ রেলপথ ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিস্তৃত হবে মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-ইরান হয়ে ইউরোপের তুরস্ক পর্যন্ত। যা পণ্য আমদানি ও রফতানি ক্ষেত্রে অর্থ ও সময় সাশ্রয় করে দেশের অর্থনৈতিক ও পর্যটন শিল্পের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের আপত্তির কারণে পরবর্তীতে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটারের রেললাইনের কাজ স্থগিত করা হয়।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল মালিক সমিতির তথ্যমতে, বছরে প্রায় ১৬ লাখ পর্যটক সমুদ্রসৈকত দেখার জন্য কক্সবাজার আসেন। নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সময় বাঁচার কারণে এই সংখ্যা এখন তিনগুণ বাড়াবে বলে তারা মনে করেন, যা দেশের পর্যটন খাত বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
বাংলাদেশ সরকার ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের অন্যতম আকর্ষণ এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝিনুক আদলের প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুটের দেশের প্রথম আইকনিক ৬ তলা রেলস্টেশনে আবাসিক সুবিধা থেকে শুরু করে ক্যান্টিন, লকার, টিকিট কাউন্টার, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশু যতœ কেন্দ্র, মসজিদ, পোস্ট অফিস, টুরিস্ট বুথ, কনভেনশন হলসহ ১৭টি বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সুবিধা। পর্যটকরা যাতে সহজে লাগেজ রেখে সৈকত উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য লকারের ব্যবস্থা।

ফলে, হোটেল ভাড়া না নিয়েও দিনে এসে পর্যটকরা দিনেই সমুদ্র ভ্রমণ শেষে ফিরে যেতে পারবেন। প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। নির্মিত রেলপথের কিছু অংশ নদ-নদী ও লোহাগড়ার চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে গেছে। বন্যপ্রাণী ও হাতির নির্বিঘেœ চলাচলের যাতে অসুবিধা না হয়, সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। সমুদ্র থেকে প্রায় ৩ কিমি দূরে ২৯ একর জায়গা জুড়ে পরিবেশবান্ধব আন্তর্জাতিক মানের স্টেশনটির চারদিকে বসানো হয়েছে কাচের আচ্ছাদন। পুরো কাঠামোর ওপরে রয়েছে ছাওনি। ছাদ খোলা থাকায় থাকবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। ফলে, দিনের বেলা বাড়তি আলোর প্রয়োজন হবে না, যা পরিবেশবান্ধব রেল স্টেশনটিকে সব সময় সহনীয় তাপমাত্রায় রাখবে।

এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। যেমন- সংস্কার প্রকল্পের আওত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতু কক্সবাজার রেল প্রকল্পের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তীতে বুয়েটের একদল দেশীয় পরামর্শক দলের সুপারিশে ৪৪ কোটি ব্যয়ে সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়াও নদ-নদীর গতিপথের বাধা সৃষ্টি না হওয়ার জন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং বাঁখখালী নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে তিনটি বড় সেতু। যাত্রীরা যাতে ভ্রমণের সময় প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করতে পারেন সে জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উচ্চগতির আমদানিকৃত বিলাসবহুল মিটারগেজ কোচ দিয়ে বগিগুলো সাজানো হয়েছে। সব শ্রেণির ভ্রমণপিপাসু সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে ঢাকা-কক্সবাজার ন্যূনতম ১৮৮ টাকা মেইল ট্রেনের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। অবশ্য প্রথমদিকে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হলেও এখনই ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হবে না।

লেখক : ড. রাজীব চক্রবর্ত্তী
সাবেক চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ ও সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক, আইকিউএসি পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম