আমিরাত থেকে রেমিট্যান্সে চমক

টানা দুই মাস কমার পর অক্টোবরে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে গতি ফিরেছে। গত মাসে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা প্রায় দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে এই রেমিট্যান্স চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অক্টোবরে প্রায় সব দেশ থেকেই প্রবাসী আয় বেড়েছে। তবে, সবচেয়ে বেশি এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। শুধু অক্টোবর নয়; বেশ কয়েক মাস ধরেই রেমিট্যান্স প্রবাহে চমক দেখিয়ে চলেছে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাজ্যের ফেডারেশন- সংযুক্ত আরব আমিরাত। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার দেশভিত্তিক রেমিট্যান্সের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে আরব আমিরাত থেকে ৩২ কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৫ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

জুলাই ও আগস্টে এসেছিল যথাক্রমে ৩২ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ও ২৩ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

সব মিলিয়ে অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবর সময়ে আরব আমিরাত থেকে ১১৫ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার (১.১৫ বিলিয়ন) টাকার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। যা এই চার মাসের মোট রেমিট্যান্সের ১৭ শতাংশ।

অক্টোবর মাসে সৌদি আরব থেকে ২৫ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ২৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার।

বরাবরই সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। গত কয়েক বছর ধরে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর তৃতীয় স্থানে ছিল আরব আমিরাত। যুক্তরাজ্য ছিল চতুর্থ অবস্থানে।

কিন্তু চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সব দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছে আরব আমিরাত। এই চার মাসে সৌদি আরব থেকে এসেছে ১০৬ কোটি ৭৯ লাখ (১.০৬ বিলিয়ন) ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৬৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। আর যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ৮২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।

আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফনের আভাস গত অর্থবছরেই পাওয়া গিয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়; আসে ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার (৩.০৩ বিলিয়ন) ডলার। যা ছিল আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে তিনটি দেশ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। বাকি দুটি দেশ ছিল সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র।

গত অর্থবছরের কয়েক মাসে সৌদি আরবের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব আমিরাত থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও বরাবরের মতোই অর্থবছর শেষে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে।

তবে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ কম ছিল; ৩৭৬ কোটি ৫২ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে; ৩৫২ কোটি ২০ লাখ (৩.৫২ বিলিয়ন) ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। ৪৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে তৃতীয় স্থানে ছিল আরব আমিরাত। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২০৮ কোটি (২.০৮ বিলিয়ন) ডলার।

সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ৬৮৮ কোটি ৪৫ লাখ (৬.৮৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

গত বছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ৭১৯ কোটি ৮৪ লাখ (৭.২০ বিলিয়ন) ডলার। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই চার মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবাসী আয় কমেছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোনো কোনো মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল আরব আমিরাত থেকে। যেমন- গত মার্চ মাসে আরব আমিরাত থেকে ৩০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ৩০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আর সৌদি আরব থেকে এসেছিল ২৮ কোটি ৩ লাখ ডলার।

শুধু মার্চ মাস নয়, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি এবং গত বছরের মে মাসেও সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল আরব আমিরাত থেকে।

জানুয়ারিতে আমিরাত থেকে ৩৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৩০ কোটি ৮৭ লাখ ও ২৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।

এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে আরব আমিরাত থেকে ৩৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। ওই মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৩২ কোটি ৯৯ লাখ ও ২৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক মাস হিসাবে আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে। এই মাসে দেশটি থেকে ৩৮ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার আসে।

আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা।

আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ২০২২ সালে আমরা প্রায় ১১ লাখ লোককে কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছি। এই সংখ্যা অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি গেছেন আরব আমিরাতে। তারই ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহে। গত বছর যারা গেছেন, তারা এখন পুরোদমে কাজ করছেন এবং বেতন-ভাতা পেয়ে দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন।

তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন বেশ চড়া। তাই তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশ আমিরাতের অর্থনীতিতেও চাঙাভাব বিরাজ করছে। সেখানকার শ্রমিকরা ভালো বেতন পাচ্ছেন। বেশি টাকা দেশে পাঠাতে পারছেন। সে কারণেই দেশটি থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসছে