মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি অদম্য ফিনিক্স পাখি

বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা। চিন্তায়, চেতনায়, মানবিকতায় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি। তিনি শুধু জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকারই নন, আদর্শেরও উত্তরসূরি। তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের নির্ভীক কান্ডারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাবা-মা, ভাই, আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে যাওয়া একজন মানুষ প্রবাসে দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে স্বদেশে ফিরেই ব্রত নিলেন স্বাধীন দেশের মানুষগুলোকে সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেবেন, শপথ নিলেন বাংলার খেটে খাওয়া ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষগুলোকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আনন্দে ভাসাবেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফেরার দিনে লাখো মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত বঙ্গবন্ধুকন্যা জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার আর হারানোর কিছুই নেই। পিতামাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং টানা তিন মেয়াদসহ মোট চার মেয়াদে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার অনবদ্য উদাহরণ সৃষ্টি করছেন দৃঢ় প্রত্যয় আর অদম্য সাহসিকতায়।

বাংলাদেশের আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সমগ্র জীবন আর বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস মূলত এক সূত্রে গাঁথা। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আত্মবিশ্বাসী দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণ একজন শেখ হাসিনাই কালক্রমে হয়ে ওঠেন বাংলার মুখ। গ্রামবাংলার ধুলোমাটি ও সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা একজন নির্ভেজাল বাঙালি নারী শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন বাঙালির মুক্তির অগ্রদূত, আশা-আকাঙ্ক্ষার বাতিঘর।

দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ভয়ানক প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর সামরিক

শাসক আর স্থাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিরা সদর্পে জানান দিচ্ছিল তাদের দাম্ভিক আস্ফাালন। এই সময়টাতে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলার সব ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কোন্দলে বিভাজিত হয়ে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। জনগণকে মিথ্যার বেসাতি দিয়ে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল তত্কালীন শাসকেরা। সে সময় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে সফল নেতৃত্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের পরের বছর নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারবিরোধী দলহীন প্রহসনের নির্বাচন করে। অতঃপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক ম্যান্ডেট নিয়ে বিজয়ী হন তিনি। দীর্ঘ ২১ বছর রাজপথে থাকা আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আবার প্রতিষ্ঠা হয়। ঘুরতে থাকে দেশের উন্নয়নের চাকা। ২০০১ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্ল্যাটফরম চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। এই সরকারের অপশাসনে দিশেহারা হয়ে ওঠে বাংলার মানুষ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে অন্তত ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। যতবারই তাকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে, ততবারই তিনি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভূমিধস জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুনশিয়ানার ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দূরদর্শী রাজনীতিক শেখ হাসিনা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়ে আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। গত দেড় দশক সরকারের নেতৃত্বে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এই সময়ে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এই উন্নয়ন-অগ্রাযাত্রা দেশের আর্থসামজিক অগ্রগতির অনবদ্য মাইলফলক। ১৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশ। এই ধারাবাহিকতায় ২০৩৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের ডিসেম্বর ২০২২-এর প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে। ২০০৭ সালে দেশের মোট কর্মসংস্থান ছিল ৪ কোটি ৭৩ লাখ। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নতুন ২ কোটি ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৬৮৬ মার্কিন ডলার থেকে চার গুণ বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ থেকে অর্ধেকের বেশি কমে ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। এ সময় অতিদারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে তিন-চতুর্থাংশ কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। গড় আয়ু বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৭৩ বছর হয়েছে। বিদ্যুত্ উত্পাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না—এই কর্মসূচির আওতায় দেশের ৯টি জেলা ও ২১১টি উপজেলা গৃহহীনমুক্ত হয়েছে। অচিরেই অন্য জেলাগুলো গৃহহীনমুক্ত হবে। গত দেড় দশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, ভূমিহীন ও গৃহহীনকে বিনা মূল্যে ঘর প্রদান, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উেক্ষপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ বিজয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, নতুন নতুন উড়ালসেতু নির্মাণ, মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন, অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর ঢাকায় বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের সাফল্যসহ স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে যাত্রা আমাদের জন্য বিস্ময়কর তো বটেই, বিশ্বের কাছেও বিস্ময়। বাংলাদেশ তাই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি বড় অংশে পরিণত হয়েছে। এত সব বড় বড় অর্জনের নেপথ্যের কারিগর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এসব অর্জনের স্বীকৃতিও মিলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বিশ্বনেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও বিশ্বজনীন নেতৃত্ব আর অর্জনের প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠভাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘Bangladesh is an example of economic progress and a country of great hope and opportunity’| কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ‘Bangladesh has made incredible progress. It spurred economic growth, reduced poverty, increased access to education and health resources and built new opportunities for the people’| ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘Bangladesh is showing its dynamism to the world under Prime Minister Hasina’s leadership, proving wrong those who had objected to the creation of Bangladesh, looked down upon the people of Bangladesh, and those who had apprehended the existence of Bangladesh’ |

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও সময়োচিত সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্ববিখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সরকার চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘এই নারী একটি শক্তির নাম’ শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড বাংলাদেশের বিগত এক দশকের অসামান্য অর্জনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্বের প্রশংসা করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী খষি সুনাক সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘আপনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘আমি আপনাকে অনেক বছর ধরে অনুসরণ করছি। আপনি একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা।’

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সোনার বাংলা নিয়ে এখনো ষড়যন্ত্র থেমে নেই। কি দেশে, কি বিদেশে। তাই শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় না থাকলে এ দেশে আবারও জঙ্গিবাদের উত্থান হবে, এই দেশ আবার অপরাধীদের অভয়ারণ্য হবে, আবার দুর্নীতির মহোত্সব হবে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবার ভূলুণ্ঠিত করবে, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ হবে—আজ সব সচেতন মানুষের মনেই আশঙ্কা জাগে। এই মুহূর্তে যদি কেউ শেখ হাসিনার বিকল্প কিছু ভাবেন, তিনি নিশ্চিত মনে মনে উচ্চারণ করেন তার ভাবনা সঠিক নয়। যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন, যারা কোনো স্বার্থের নাগপাশে নিজের বিবেক বিসর্জন দেননি, দেশপ্রেম এখনো যাদের রক্তে-মগজে নিত্য দোলা দেয়—এমন মুক্ত মানুষও আজ ভাবেন, বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার একমাত্র বিকল্প শেখ হাসিনা নিজেই।

লেখক: শ ম রেজাউল করিম, এমপি
সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়