শেখ হাসিনা : বিশ্বে বিরল নেতা

জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। যিনি বাঙালি জাতির ঐক্যের প্রতীক। তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, দক্ষ প্রশাসক, দক্ষ রাজনীতিবিদ, দক্ষ কূটনীতিবিদ, দক্ষ অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরইমধ্যে তিনি তার দূরদর্শিতা, ত্যাগ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা, শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, করোনা মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্যবিমোচন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ও উন্নয়ন এবং দেশের মধ্যে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন মযার্দাপূর্ণ অসংখ্য খেতাব, ডিগ্রি, পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতি।

অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের লেখা ‘রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার পথচলা’ শীর্ষক গ্রন্থে বিভিন্ন পত্রিকার খবরের বরাত দিয়ে উঠে এসেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দিনটির বর্ণনা যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনা জনতাকে উদ্দেশ্য করে কি বলেছিলেন: ‘আমি নেতা নই, সাধারণ মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী, আপনাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের নিয়ে নিরলস সংগ্রাম করে যাবো।’

তিনি সেই দিনটি থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বারবার মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছেন। তিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখে সোনার বাংলা গড়ার কাজে প্রতিটি সেকে- সঠিকভাবে ব্যবহার করছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা টুঙ্গিপাড়ার গ্রামবাংলার ধুলোমাটি আর সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। জন্মসূত্রেই তিনি একজন রাজনীতিবিদ। কারণ রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকার বকশীবাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গালর্স কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি নিজ যোগ্যতা ও নেতৃত্বের গুণে কলেজছাত্রী সংসদের সহ-সভানেত্রী (ভিপি) পদে নিবার্চিত হন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬ দফা দাবিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় অমানবিক দমন আর নির্যাতন। কারাগারে আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দায়ের করেন মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তার জীবন ও পরিবারের ওপর নেমে আসে গভীর শঙ্কা ও দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট। সেই পরিস্থিতিতে বঙ্গমাতা সঠিকভাবে পরিবার ও দলের হাল ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন কাছে থেকে দেখেছেন কীভাবে বিপদ মোকাবিলা করতে হয়। কীভাবে অন্যায়কে পদদলিত করে বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনতে হয়। এই ঝড়ো দিনগুলোতেই একদিকে পিতা কারাবন্দি অন্যদিকে পিতার আগ্রহে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী, শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র, নম্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে ১৯৬৮ সালে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান।

শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে তাতে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।

ইতিহাসের কালো দিন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। যেমনভাবে বঙ্গবন্ধুকে জেলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল।

বাংলার মানুষের ডাকে সেদিন দেশমাতৃকার হাল ধরেন শেখ হাসিনা। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশের মাটিতে লাখ লাখ জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা।

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বাংলার মানুষের ভাত আর ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় ত্যাগ আর সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনো কিছুই তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ। ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। সম্পাদিত হয় পাবর্ত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। বাংলাদেশ অজর্ন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্তা। প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে। দারিদ্র্য হ্রাস পায়।

খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ায় জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার প্রথমবারের (১৯৯৬-২০০১) শাসনকাল চিহ্নিত হয় বাংলার ইতিহাসের স্বণর্যুগ হিসেবে। ২০০১ সালের ষড়যন্ত্র ও কারচুপির নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। এ সময় দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে জোট সরকার সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দলীয় নেতাকর্মীর উপরে নেমে আসে নির্যাতন, নিপীড়ন আর মিথ্যা মামলা। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে চালানো হয় পরিকল্পিতভাবে গ্রেনেড হামলা। শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল এই হামলার মূল লক্ষ্য। গুরুতরভাবে আহত হলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে যান মানবতার মা জননেত্রী শেখ হাসিনা। আবারো প্রমাণিত হয় রাখে আল্লাহ মারে কে! তবে এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রায়ত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী শাহাদত বরণ করেন। চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান অসংখ্য নেতাকর্মী ও তাদের পরিবার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন-চতুর্থ অংশের বেশি আসন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো মহাজোট সরকার গঠিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শীতার মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফিরে আসে দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা। শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। ২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনার সুযোগ পান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় আসার পর তার গৃহীত পদক্ষেপে দেশবাসী আজ বিভিন্ন ধরনের সুফল পাচ্ছেন। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

এক বণার্ঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারানির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছেন। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে।

অসংখ্যবার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য স্থির রেখে কাজ করে চলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার স্পষ্ট কথা, দেশ আমাদের, দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। ভিসানীতি বা নিষেধাজ্ঞার ভয় আমাদের দেখিয়ে লাভ নেই। নৌকা সারাজীবন উজান ঠেলে এগিয়েছে। উজান ঠেলেই এগিয়ে যাবে।’

সহজ সারল্যে ভরা তার ব্যক্তিগত কর্মময় জীবন। মেধা-মনন, কঠোর পরিশ্রম, সাহস, ধৈর্য, দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে উঠেছে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কন্যা। চলাফেরা, পোশাকে-আশাকে, জীবনযাত্রায় কোথাও বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার কোনো ছাপ নেই তার। তিনি একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, ধার্মিক খাঁটি মুসলমান। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে তার দিনের সূচনা ঘটে এবং কাজ শুরু করেন। পবিত্র হজ ও ওমরা পালন করেছেন কয়েকবার। বাংলার মাটিতে গড়ে তুলেছেন মডেল মসজিদ। ইসলামের প্রসারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কাওমি শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। ইসলাম শিক্ষার গুরুত্ব, ইসলামের প্রচার ও প্রসারতাই ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন।

মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল আজ বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, দূরদশির্তা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের মর্যাদার আসনে। একবিংশ শতাব্দীর অভিযাত্রায় দিনবদলের সনদের মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সফল ও সুনিপুণ কারিগর শেখ হাসিনা। তিনিই বাঙালির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। বাংলার মানুষের ভালোবাসায় তিনি সিক্ত। তিনি বাংলার মানুষের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। শেখ হাসিনার বিকল্প কেবলই শেখ হাসিনা। তার ধ্যান, কর্ম, জ্ঞান একটি আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য।

লেখক: ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা
শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।