জি-২০ সম্মেলন একটি বৈশ্বিক মহাসম্মেলন। এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৮তম জি-২০ সম্মেলন। সম্মেলনটি হচ্ছে একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আয়োজক দেশ হিসেবে জি-২০ সম্মেলনকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়েছে ভারত। ভারত তাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি দিয়ে এই সম্মেলনটি করেছে। এক বছর আগে থেকে এই সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। এই সম্মেলন উপলক্ষে ভারতের ৫০টি শহরে প্রায় ২০০টি সভা করেছে দেশটির সরকার।
এবারের জি-২০ সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এবারের জি-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের জি-২০ সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- জাতিসংঘের বাইরে এটা বিশ্বের সব থেকে বড় মঞ্চ, যেখানে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এক সঙ্গে বসে। তারা নিজেদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
জি-২০ এর এই সম্মেলনে চীন এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা অংশগ্রহণ করেননি। তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও ভ্লাদিম পুতিন এবং শি-জিনপিংয়ের মতো বিশ্ব নেতাদের অনুপস্থিতি একদিকে জি-টুয়েন্টির গুরুত্ব কমিয়েছে অপরদিকে চীন এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক প্রভাবের জায়গাটাও হ্রাস করেছে। এক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
সম্মেলনে ভারতের ভূমিকাটা খুবই প্রশংসনীয়। এই শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেছেন। একই সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মরিশাসের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গেও দেখা করেছেন।
এবারের জি-২০ সম্মেলনের স্লোগান হলো- ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার এবং এক ভবিষ্যৎ।’ অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টা ভারত সফলভাবেই করেছে। বলা যায় গ্লোবাল সাউথ অর্থাৎ দক্ষিণের দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে ভারত। ভারত এখানে বহুপাক্ষিকতাবাদকে সামনে এনেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অর্থনৈতিক অর্জনকে তারা দেখাতে পারছে। সম্মেলনের জন্য যে স্থানটি নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা ভারতের একটি স্থাপত্য নিদর্শন। সম্মেলনের আগে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক জি-টুয়েন্টি সম্মেলনের আলোচ্য সূচির সাথে এসব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সম্মেলনের আগে এবং পরে মিলে প্রায় ১৫টি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এবং অন্যান্য দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা গুরুত্বের সঙ্গে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্ব অর্থনীতি, বিশ্ব রাজনীতি বা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।
যদিও এই জি-২০ সম্মেলনের যৌথ ঘোষণার ভাষা কী হবে, ইউক্রেন যুদ্ধকে এই ঘোষণায় কিভাবে উল্লেখ করা হবে এসব বিষয়ে রাশিয়া এবং চীনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে এই বিষয়গুলো আগে থেকেই অনুমেয় এবং এখানে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বিশ্ব নেতাদের এই একটি মঞ্চে উপনীত হওয়া, এটা আয়োজনকারী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের একটি বড় সাফল্য।
ইতোমধ্যে এই সম্মেলনের একটি বড় অর্জন আমরা দেখতে পেয়েছি। চীন এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুপস্থিতিতে জি-টুয়েন্টির ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনার যৌথ ঘোষণা একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন। আমরা জানি রাশিয়া এবং চীনের সাথে পশ্চিমা নেতাদের একটি বড় মতপার্থক্য ছিল ইউক্রেন ইস্যুতে। এই বিষয়টাকে কিভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটা নিয়ে ছিল মতানৈক্য। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে সেই বিষয়গুলোকে এই যৌথ ঘোষণায় স্থান দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ দুপক্ষই সমঝোতা পোষণ করার জন্য এক ধরনের ছাড় দিয়েছে। যৌথ ঘোষণাটি যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে পুরো বিষয়টিই জি-টুয়েন্টির ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক। যদিও এখানের সমঝোতাগুলো কতটা বাস্তবায়িত হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, সম্মেলনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, এটা বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় কূটনৈতিক অর্জন। একই সঙ্গে একটি বড় ফোরামে বাংলাদেশ নিজস্ব বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভারতের সঙ্গে তিনটি সমঝোতা স্মারক এবং ভারতের সঙ্গে আমাদের কানেক্টিভিটির কিছু প্রজেক্ট উদ্বোধন করা হয়েছে।
আলোচনার মধ্যেও আমরা দেখেছি, দুই দেশের কানেক্টিভিটির জায়গাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাণিজ্যসহ রোহিঙ্গা ইস্যু এবং অন্যান্য ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী একান্তে কথা বলেছেন, সেখানে ভূ-রাজনৈতিক ও দ্বিপাক্ষিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
জি-টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের যেমন একটি দ্বিপাক্ষিক দিক রয়েছে পাশাপাশি এখানে একটি বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক বিষয় যুক্ত। এই মুহূর্তে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশই পরাশক্তিগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। অনেক কৌশলের সঙ্গে সেই চাপগুলোকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই জায়গায় বাংলাদেশ আরও বেশি দর কষাকষি সুযোগ পেয়েছে। কারণ আমরা জানি, বাংলাদেশ শুধু জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ বা ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকই করেনি পাশাপাশি আমরা দেখেছি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সব মিলিয়ে কূটনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক গুরুত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি। গত এক দশকে বাংলাদেশের যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে এবং তার সঙ্গে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে জোরালো ভূমিকা রাখছে তার একটি স্বীকৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এমনকি বাংলাদেশ যে ইন্দোপ্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা করেছে সেই আউটলুকের কিছু বিষয়ও জি-২০ সামিট এবং ভারত যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ঘোষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি। ইন্দোপ্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশ যা বলেছে অন্যরাও সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছেন সেটা ছিল সমগ্র বিশ্বের সামনে একটি রোড ম্যাপ। জি-টুয়েন্টির মূল উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সেখানে বেশ কয়েকটি বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়ন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন না করলে জি-২০ এর মূল লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জি-টুয়েন্টির মূল লক্ষ্যগুলোর সাথে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যকে একত্র করেছেন এবং এই লক্ষ্য অনুযায়ী সুপারিশ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যে সমস্ত দেশগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের সহযোগিতা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয় বরং উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্যই এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয় আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে যেটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই কার্যকর। আমরা জানি, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আরও একটি বিষয় যুক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এই দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার সাথে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংযুক্তি প্রয়োজন। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ত্রিমাত্রিক সহযোগিতার কথা বলেছেন। একই সাথে তিনি যে কোনো দেশের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের প্রতি আরো মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এবারের জি-টোয়েন্টির সম্মেলনের মূল স্লোগান ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ বাস্তবায়ন করতে হলে সেটা দলিলের পাশাপাশি বাস্তবেও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় দক্ষিণের দেশগুলোর ঝুঁকি এবং বৈষম্য মোকাবিলায় একতাবদ্ধ হওয়ার প্রতি জোর দিয়েছেন। সব মিলিয়ে জি-টুয়েন্টির যৌথ ঘোষণাটি যেমন ইতিবাচক একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং যে সুপারিশগুলো করেছেন সেগুলো জি-টুয়েন্টি বৈঠকের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
সামনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কিভাবে সম্পর্ক বজায় রাখছে এবং বিদ্যমান ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ তার চলমান পররাষ্ট্র নীতি- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ সেটি বজায় রাখার ক্ষেত্রে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রের ক্ষতি করে অন্য রাষ্ট্রকে সাহায্য করার কোনো লক্ষ্য বাংলাদেশের নেই। এই বিষয়গুলো আরো পরিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবমিলে এটা বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের বড় কূটনৈতিক সাফল্য।
ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ তার সঙ্গে জি-২০ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের মধ্যে সামাজিক সৌজন্যতার প্রকাশ এবং আন্তরিকতার সাথে কথা বলা, এগুলো অসাধারণ বিষয়। অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। অতএব, এবারের জি-টুয়েন্টি সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণটা একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য স্বারক।
লেখক: ড. দেলোয়ার হোসেন,
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন