জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভালো করেই জানতেন যে অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারে না। সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই তিনি এই দর্শনের বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিল, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবস্থা, তা থেকে উত্তরণ ছিল সত্যিই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই অভিজ্ঞতাই বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলো যে একই বাস্তবতার সম্মুখীন, তা অনুধাবন করতে সাহায্য করে।
তাই যেখানেই তিনি সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাঁর আপসহীন বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু মোট পাঁচটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, যেমন—১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত কানাডার অটোয়ায় কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সভা ও আলজেরিয়ার আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন, ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশন এবং ১৯৭৫ সালে জামাইকার রাজধানী কিংস্টনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সভা। তবে লাহোরের ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন ছাড়া অন্য সব সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু অনুন্নত জাতিগুলোর অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
অটোয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সভায় বঙ্গবন্ধু ৩ আগস্ট উদ্বোধনী অধিবেশনে এবং ৭ আগস্ট বাণিজ্য, শুল্ক ও আর্থিক বিষয়ক অধিবেশনে বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন যে দরিদ্র দেশগুলো দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অশিক্ষা, রোগবালাই ও বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। তিনি উন্নত বিশ্বের কাছে সেই উদ্বেগগুলো ভাগ করে নেওয়ার আহ্বান জানান। বিদ্যমান অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের নীতিমালা উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য শর্তাবলি আরো জটিল করে তোলে, উন্নত দেশগুলোর বাজারে তাদের পণ্যের প্রবেশ সীমিত করে, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে হ্রাস করে এবং তাদের ওপর অসহনীয় ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়।’
৭ আগস্ট বাণিজ্য, শুল্ক ও মুদ্রা বিষয়ক অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে বৈষম্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা, উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগসংক্রান্ত সমস্যা, তাদের বাণিজ্য পরিস্থিতির অবনতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্তিতে কমনওয়েলথের বাকি সদস্যদের, বিশেষ করে দরিদ্র সদস্যদের ওপর বিরূপ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা বজায় রাখার পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করেন যে কমনওয়েলথের উন্নত দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সমন্বয় সাধনে নেতৃত্ব দেবে, যার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের তুলনামূলক সুবিধার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হবে। তিনি ধনী কমনওয়েলথ দেশগুলোকে তাদের জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশে নির্ধারিত উন্নয়ন সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জোরালো আহ্বান জানান।
আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে শান্তির জন্য অর্থনীতির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধনী দেশগুলো সমন্বিত ও সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমে এবং অনেক সময় দরিদ্র দেশগুলোর ভাগ্যের বিনিময়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা দরিদ্র দেশগুলো অন্যদিকে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন।
বাণিজ্যিক অবস্থার অবনতি, রপ্তানিতে অচলাবস্থা এবং খাদ্য ঘাটতির কারণে আমরা দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা, রোগ ও বেকারত্বের ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে; কারণ আমাদের বেঁচে থাকাটাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’ তিনি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে লুসাকা ও জর্জটাউনে গৃহীত ‘আত্মনির্ভরতা’ এবং ‘উপস্থিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর মধ্যে কার্যকর অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ নামের দুটি মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি ‘অ্যাকশন প্রগ্রাম’ তৈরির পরামর্শ দেন।
তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক মুক্তিতে বঙ্গবন্ধুজাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলা করার জন্য জরুরিভাবে একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উত্থাপন করে জাতির পিতা বলেছিলেন যে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ফলে আমাদের মতো একটি দেশের জন্য পরিশোধের ভারসাম্যের ব্যবধান হয়েছে শত শত মিলিয়ন ডলার। এর ফলে মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই, বার্ষিক মাথাপিছু ১০০ ডলারের কম আয়ের লোকরা তাদের বর্তমান জীবনযাত্রার স্তরের চেয়েও মান কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন যে উন্নত দেশ থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি করায় এর দাম বেড়েই চলছে। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; গুরুত্বপূর্ণ কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণের কথাও তিনি বিশ্বনেতাদের জানান।
একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘকে যে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে তার উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ ধরনের ব্যবস্থায় শুধু নিজ নিজ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করাই নয়, এতে একটা স্থায়ী ও যথার্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য বিশ্বের দেশগুলোর সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করারও প্রয়োজন পড়বে। তিনি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে নিশ্চিত করা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার যাতে সর্বত্র সবাই ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানবজাতির সাধারণ কল্যাণে সেই সম্পদ ব্যবহার করারও আহ্বান জানান।
১৯৭৫ সালের ২৯ এপ্রিল কিংস্টনে কমনওয়েলথের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বিশ্বের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে তিনি বলেন, কমনওয়েলথের ধনী দেশগুলোকে অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দ্রুত স্বল্পমেয়াদি সহায়তা দিতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য ঘাটতি পূরণে কমনওয়েলথের উদ্বৃত্ত খাদ্যসমৃদ্ধ দেশগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গঠনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর সম্পদ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্যক্রমেও কাজে লাগানো যাবে। তিনি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন।
২ মের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে বিশ্ব সহযোগিতার অর্থবহ কাঠামোর আওতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ ও জনশক্তির পূর্ণ ব্যবহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে উদ্বৃত্ত সম্পদ রয়েছে এমন দেশগুলোকে তাদের সম্পদ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করেন যে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি ও বাণিজ্য ঘাটতির ক্রমাগত প্রবণতা এবং মুদ্রাব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বৈষম্য বাড়িয়েই চলছে।
নিঃসন্দেহে বর্ণিত ঘটনাগুলো তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকার কয়েকটি উদাহরণ, যা সেদিন সেসব দেশের নেতাদের তাঁদের জনগণকে একটি সম্মানজনক জীবন দেওয়ার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক দুর্গতি ও সামাজিক অবিচার থেকে মুক্ত করতে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় ৫০ বছর আগের সেই দাবিগুলো আদায়ের জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আজও লড়াই করে যাচ্ছে।
লেখক : এ কে এম আতিকুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব