ভূগর্ভস্থ লাইন স্থাপনের (আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল নেটওয়ার্ক) মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর রাস্তা থেকে বিদ্যুতের খুঁটি ও তারের জঞ্জাল সরিয়ে বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা বদলে ফেলার কাজ শুরু করেছে সরকার। এরই মধ্যে এই কাজের অগ্রগতিও বেশ এগিয়ে গেছে। মূলত শহরকে জঞ্জালমুক্ত ও নিরাপদ করতে এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা প্রদানের লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরকার ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর দেশি কেবল উৎপাদনকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল উৎপাদনে ঝুঁকেছে।
চলমান প্রকল্পগুলোতে যে পরিমাণ আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল প্রয়োজন তার পুরোটাই দেশি কম্পানি সরবরাহ করতে সক্ষম বলে এই খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও শিল্প-কারখানার প্রসারে ব্যাপকভাবে বেড়েছে বৈদ্যুতিক কেবলের চাহিদা। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এই খাতের বাজারও। বর্তমানে দেশে বৈদ্যুতিক কেবলের মোট বাজার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার।
এক দশক তা ছিল দুই হাজার কোটি টাকার। বছরে ২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দেশে নতুন করে আন্ডারগ্রাউন্ড কেবলের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে আন্ডারগ্রাউন্ড বা মিডিয়াম ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক কেবলের বাজার প্রায় এক হাজার কোটি টাকার।
বিআরবি, বিজলী কেবলস, বিবিএস ও পারটেক্সসহ বেশ কয়েকটি দেশি কম্পানি আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল উৎপাদন করছে। এসব কম্পানি মোট ব্যবহারের ২০ শতাংশের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৮০ শতাংশ চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রথম ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায়। রাজধানীর সব বৈদ্যুতিক তার মাটির নিচে নিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে দুই বিতরণকারী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি (ডেসকো)।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে মাটির ওপরে থাকা তার নিচে নেওয়ার কাজ করছে। চলমান প্রকল্পের কাজগুলো বাস্তবায়ন করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএনটিআইসি ও এসপিআইটিসি যৌথভাবে এবং অস্ট্রেলিয়ান কম্পানি এনার্জি ট্রন আরঅ্যান্ডডি কেআইএস গ্রুপ। অন্যদিকে ডেসকো তাদের সব বিতরণ এলাকায় এরই মধ্যে ১৩২ কেভি এবং ৩৩ কেভি বিদ্যুতের লাইন শতভাগ মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার কাজ শেষ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন ১১ কেভি লাইনগুলোও মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেছে।
বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ করায় আন্ডারগ্রাউন্ড কেবলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বিদেশ থেকে এনে ব্যবহার করেছে। তবে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থায়নে পরিচালিত কিছু প্রকল্পে ১১/৩৩ কেভি ওভারহেড এবং আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল সরবরাহ করতে পারছে দেশি কম্পানিগুলো।
৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আরএফএলের
দেশে আন্ডারগ্রাউন্ড কেবলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে শিল্প গ্রুপ আরএফএল। আরএফএলের উৎপাদিত কেবল বাজারে ‘বিজলী কেবলস’ নামে পরিচিত। সম্প্রতি সরেজমিনে দেশের সবচেয়ে বড় হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, ২৫০ একর জমির ওপর ২০ ধরনের পণ্যের উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে আরএফএল গ্রুপ। এখানে ২৫ হাজার কর্মী কাজ করছেন। আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল তৈরি করতে ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এক লাখ ২০ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি আলাদা কারখানা তৈরি করেছে, যা চলতি বছরের এপ্রিলে চালু হয়।
আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আর এন পাল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের আন্ডগ্রাউন্ড কেবল এখন দেশি কম্পানিগুলোই তৈরি করছে। সরকারের চলমান প্রকল্পে যে পরিমাণ আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল প্রয়োজন হবে তার পুরোটাই দেশি কম্পানি সরবরাহ করতে সক্ষম। আরএফএলের কারখানায় আন্ডারগ্রাউন্ড বা হাই টেনশন কেবলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার টন। বাজারে এর চেয়েও বেশি উৎপাদন সক্ষমতার কম্পানি রয়েছে।’ আমদানীকৃত কেবল থেকে ১০ শতাংশ কম দামে দেশি কম্পানিগুলো কেবল দিতে পারবে বলেও তিনি জানান। আর এন পাল বলেন, ‘বর্তমানে সরকারের বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেখানে বিদেশ থেকে তার আমদানির শর্ত রয়েছে। এসব শর্ত উন্মুক্ত করা গেলে দেশি কম্পানিগুলোই চাহিদার পুরোটা জোগান দিতে পারবে। এসব কেবলের বেশির ভাগ চীন থেকে আসে। ফলে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি বাংলাদেশে উৎপাদিত কেবল ব্যবহার করে, তাহলে তাদের সময় ও খরচ সাশ্রয় হবে।’
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, ‘বর্তমানে আরএফএলের বিজলী কেবলসসহ দেশি বেশ কয়েকটি কম্পানি খুবই উন্নতমানের কেবল উৎপাদন করছে। যার কারণে এখন আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে দেশি কম্পানির কেবল ব্যবহার করছি। সরকারের পক্ষ থেকেও দেশি কম্পানির কেবল ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। যার কারণে সম্প্রতি একটি টেন্ডার দিয়েছি, সেখানেও দেশি কেবল ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে, যা গত কয়েক বছর আগের প্রকল্পগুলোতে ছিল না।’
বিজলী কেবলসের ফ্যাক্টরি প্রধান মো. আবুল বাশার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের কেবল উৎপাদন করায় বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিগুলো বিভিন্ন প্রকল্পে আমাদের কেবল ব্যবহার করছে। বিজলী কেবলস ভারত ও আফ্রিকায় রপ্তানিও হচ্ছে।’