একটি দেশের সাধারণ নাগরিকেরা তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কামনা করে। আর সরকার জনগণের সেই প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য নানা ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। সরকার তার উন্নয়ন পরিকল্পনা এমনভাবে ঢেলে সাজায়, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে সেই উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন। তাই বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি ও রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য ছোট-বড় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাট নির্মাণ, বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সরকার তার উন্নয়ন কার্যক্রমকে সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান করতে তত্পর থাকে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাট নির্মাণ বা ব্রিজ-কালভার্ট তৈরিকে বোঝায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিধি আরো অনেক ব্যাপক।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে বিশাল একটি পরিসরকে বোঝায়। উন্নয়নের সঙ্গে আমরা অর্থনৈতিক শব্দটি যোগ করি ঠিকই, কিন্তু সার্বিকভাবে উন্নয়ন বলতে আরো অনেক কিছু বোঝায়। উন্নয়ন হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে একটি ব্যাপক পরিবর্তন। জনস্বার্থে সংঘটিত পরিবর্তনকেই আমরা সাধারণভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে পারি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে দীর্ঘদিন পড়িয়েছি। কাজেই আমি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে একটু ভিন্ন পরিসরে জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির বাইরের অনেক বিষয়ও যুক্ত রয়েছে। উন্নয়নের সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় এসে যায়। অর্থাত্ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধিত হলেই তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না, যদি একই সঙ্গে অন্যান্য খাতের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন সাধিত না হয়। সমাজের জন্য কল্যাণকর এমন অনেক কিছুই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার গুণগত মান এবং পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইস্যুটিকে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন।
একজন প্রখ্যাত সুইডিশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যদি কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তাকে আমি প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলব। একটি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যখন দীর্ঘদিন ক্রমাগত ৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ হারে বাড়তে থাকবে, গড় জিডিপির হার ক্রমাগত অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর টেকসইভাবে বাড়তে থাকবে, তখন তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শুধু আর্থিক সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকলেই তাকে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যায় না। এর সঙ্গে সামাজিক অন্যান্য সূচকও ইতিবাচক ধারায় থাকতে হবে। যেমন—কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উচ্চমাত্রায় থাকলেও সেই প্রবৃদ্ধির সুফল যদি সামান্য কিছু মানুষের কাছে কুক্ষিগত হয়, সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সেই অবস্থাকে প্রকৃত বা সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না।
সব স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন, শিক্ষার গুণমান নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ছেলেমেয়ে যাতে স্কুলে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনোভাবেই একটি দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠতে পারে না। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি একটি দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কোনো দেশের নাগরিকদের প্রকৃৃত মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে সে দেশ দরিদ্র, বেকারত্ব ও নিম্ন জীবনমান পর্যায়ে থাকবে। সাধারণ মানুষের স্বস্থ্যের প্রতিও নজর দিতে হবে। কারণ একজন মানুষ যদি শারীরিকভাবে সক্ষম না হন, তাহলে তার পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক কর্মপরিবেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যকর আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অস্বাস্থ্যকর আবাসনব্যবস্থা একজন মানুষের কর্মশক্তিকে নষ্ট করে দিতে পারে। কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে, যাতে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। পরস্পর আলোচনা করলে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটতে পারে। চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা থাকলে মানুষ নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পায়।
‘ডেভেলপমেন্ট উইথ ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিজ’ বলে একটি কথা আছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের সুফল যদি সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই ও স্থিতিশীল হতে পারে না। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, তবে আমাদের একই সঙ্গে দেখতে হবে সমাজে বৈষম্য কতটা আছে। আমরা সব সময়ই চাই বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তার যোগ্যতাবলে উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারবে। উন্নয়নের সুফল সামান্য কিছু ভাগ্যবানের হাতে পুঞ্জীভূত হবে না। আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনা করি, তাহলে দেখব, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছে। একসময় যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এবং ‘টেস্টকেস’ বলে উপহাস করা হতো, আজ সেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু আমরা কি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পেরেছি? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের দেশে বিত্তবান-বিত্তহীনের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। আজ সেই বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গবেষণা প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চেতনা ছিল বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমরা কি সেই প্রত্যাশিত শোষণমুক্ত সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পেরেছি? বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে।
উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি—শুধু এগুলো ঘটলেই তাকে প্রকৃত ও সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যাবে না। সাধারণ মানুষের সামাজিক অবস্থা কতটা পরিবর্তন হলো, শিক্ষাব্যবস্থার কতটা উন্নতি হলো, সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা, কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা গেল কি না—এসব বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় দ্বারা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় দ্বারা একটি দেশের অর্থনৈতিক চিত্র কিছুটা পাওয়া গেলেও তা সবার প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করে না। যেমন—এক জন মানুষের বার্ষিক আয় হয়তো ১ কোটি টাকা। আর এক জনের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১ লাখ টাকা। তাহলে তাদের দুজনের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় দাঁড়াবে ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এভাবে মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় নির্ধারণ করা হলে উভয়ের প্রতিই অবিচার করা হবে। প্রথম জনের প্রকৃত আয় কমে যাবে। আর দ্বিতীয় জনের ক্ষেত্রে প্রকৃত আয়ের প্রতিফলন ঘটবে না। মূলত এ কারণেই কোনো কোনো দেশ সুখের বিপরীতে জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপ করার চেষ্টা করছে। গড় মাথাপিছু জাতীয় আয়কে ক্রুড এভারেজ বলা যেতে পারে। এটা মানুষের আয় বা অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রকৃত চিত্র নয়। আমাদের দেশে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বিত্তবান মানুষগুলো বিত্তবান হচ্ছে, আর দরিদ্র মানুষগুলো আরো দরিদ্র হচ্ছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে হলে পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। সেই সম্পদ রূপান্তর ও পরিমার্জনের মাধ্যমে বাড়াতে হবে। সম্পদের মালিকানাগত বৈষম্য দূর করতে হবে। এক জনের হয়তো ১০০ বিঘা জমি আছে আর এক জনের এক বিঘা জমি আছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ভূমি সংস্কার করতে হবে। অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে অর্জিত আয় সাধারণ মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে পেতে পারে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিত্সা। এক জন মানুষ তার বসবাসকারী রাষ্ট্রের কাছে এই পাঁচটি অধিকার দাবি করতে পারে। আর রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য এই সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই পাঁচটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা গেলেই শুধু একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হতে পারে। সুইডিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিট গুলেট বলেছেন, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাদের ফিলিং অব সেল্প রিস্পেক্ট থাকতে হবে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এক জন যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বাধীন চিন্তা এবং তার মতামত ব্যক্ত করতে পারে, অন্যের অবজ্ঞা থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা ভোগ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকতে হবে। এগুলোই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল শর্ত। সমাজে যখন এসব শর্ত বিদ্যমান থাকবে, তখন বলা যাবে টেকসই ও কার্যকর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, উন্নয়ন হচ্ছে পরিবর্তন, যা হবে ইতিবাচক। অর্থাত্ সমাজ ও মানুষের জন্য সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
লেখক :প্রফেসর ড. মমতাজ উদ্দিন আহমদ
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক