৭৭তম বছরে এসেও বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পাকিস্তান

১৪ আগস্ট, পাকিস্তানের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। যার একটি পাকিস্তান। কিন্তু ভৌগলিকভাবে পাকিস্তান পূর্ব এবং পশ্চিম এই দুই অংশে বিভক্ত ছিল, যা ১৯৫৫ সালের মারি চুক্তির ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান এবং মূল পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পরিণত হয়। গড়ে ওঠে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি।

কিন্তু, জন্মের শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ব বাংলার প্রতি ভয়াবহ রকমের বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান ছিল প্রচণ্ড অবহেলিত ও নিষ্পেষিত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে তারা সবসময় প্রাধান্য দিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে। যার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ জনগণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। জন্ম নেয় আজকের স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।

সময় বদলেছে। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করলেও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে সেই পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ আজ অনেক পরিণত। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অর্থনীতি, রাজনীতিতে করেছে ব্যাপক উন্নতি যা পাকিস্তানের জন্য রীতিমতো ঈর্ষনীয়। যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে দ্বার করিয়ে দিয়েছিল ধ্বংসের প্রান্তে, আজ তাদের থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সব সূচকেই পাকিস্তানকে অনেকাংশে টপকে গেছে বাংলাদেশ।

বিশেষ করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।

২০২৩ সালের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনামূলক এমন কতগুলো সূচক আছে, যা থেকে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান আজ আর কোনো তুলনীয় রাষ্ট্র নয়। সূচকগুলো হলো-

এক. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের জিডিপি ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের চেয়ে ১১৯ বিলিয়ন কম।

দুই. পাকিস্তানের মোট জিডিপি আমাদের চেয়ে কম, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। সেখানে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ১ শতাংশ; আর বাংলাদেশে এ হার ১ দশমিক ২ শতাংশ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে ২২ কোটি; আর বাংলাদেশে ১৭ কোটি। অথচ ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি; আর সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটিরও বেশি।

তিন. মাথাপিছু আয়কে সামনে আনা যাক। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৭৬৫ ডলার। যেখানে পাকিস্তানের কমে গিয়েছে ১১ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ১৩৯৯.১ ডলার।

চার. রপ্তানি আয়ের পার্থক্যটাও লক্ষণীয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় ৫৫.৫ বিলিয়ন ডলার; যেখানে পাকিস্তানের ৩৯.৪ বিলিয়ন ডলার।

পাঁচ. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সরকারের ও আইএমএফের হিসাবে গরমিল আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে সরকারি হিসাবমতে কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু আইএমএফ বলছে সঠিক হিসাব হলো, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। আমরা যদি সর্বনিম্ন হিসাবটিও ধরি, তাহলেও তা দিয়ে তিন মাসেরও বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে একই সময়ে পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে মাত্র ৩ সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটান যেতে পারে।

ছয়. বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ; আর পাকিস্তানের বেলায় তা জিডিপির প্রায় ৪৭ শতাংশ।

সাত. নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বাড়ির আঙিনার বাইরে গিয়ে কর্মরত নারীর অনুপাত পাকিস্তানে ১৪ শতাংশের বেশি নয়; অথচ বাংলাদেশের বেলায় এ হার ৩৬ শতাংশেরও বেশি।

আট. আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ জন; অন্যদিকে পাকিস্তানে বর্তমানে তা হাজারে ৫৯ জন।

নয়. বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু যেখানে ৭৩ বছর; পাকিস্তানের বেলায় তা মাত্র ৬৬ বছর।

দশ. বাংলাদেশে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু পাকিস্তানে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে অবস্থান করছে।

এগারো. স্থানীয় মুদ্রার কথায় আসি-২০০৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রুপির মূল্যমান বাংলাদেশের টাকার চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি ছিল। ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশের বাজারে ১০৭ টাকায় ১ ডলার কেনা যায়; কিন্তু পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে হলে ২৭৭ রুপি খরচ করতে হয়।

বারো. বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার হচ্ছে ৭৬ শতাংশ; আর পাকিস্তানের বেলায় তা মাত্র ৫৯ শতাংশ।

তেরো. জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে। ২০২২ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯; আর পাকিস্তানের অবস্থান ১৪৭।

এছাড়া, বর্তমান বাংলাদেশ জঙ্গী ও সন্ত্রাসী মুক্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির দেশ। যেখানে, পাকিস্তানে একটি সরকারও তার মেয়াদ পূর্ণ করেতে পারেনি। বর্তমানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আছেন জেলে। নির্বাচন নিয়ে তাদের দেশে চলছে রীতিমতো রঙ্গতামাশা। অথচ বাংলাদেশের ২ জন নেন্ত্রী সফলভাবে দেশ চালিয়ে আসছেন।

এসব সূচক বিচেনায় নিয়ে স্পষ্টভাবেই বলা চলে, আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো তুলনা চলে না। বাংলাদেশের তুলনা হতে পারে সফল কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে। অর্থাৎ, বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের চেয়ে অনেকাংশেই উন্নত।