আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী ইছামতি। দেখা গেলো উপহারের ঘরের পাশে সামান্য কিছু জায়গায় চাষ করা হয়েছে শাকসবজি। রোপণ করা হয়েছে কয়েকটি ফুল ও ফলগাছ। এসব গাছের পরিচর্যা করছিলেন রিপন-রাহিমা দম্পতি।
নিজেদের মতো বাড়ি গোছাতে ব্যস্ত এ দম্পতি ছয় মাস আগেও ছিলেন অন্যের বাড়ির ভাড়াটিয়া। শ্রমিক রিপনের ছিল না বাড়ি কেনার সামর্থ্য। তবে গত মার্চে মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে চতুর্থ পর্যায়ে (আশ্রয়ণ-২) প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পাল্টে দিয়েছে তাদের জীবন।
ঘরের পাশে গাছ পরিচর্যা করা অবস্থায় কথা হয় রাহিমা বেগমের সঙ্গে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি বলেন, ‘আগে আমরা ভাড়া থাকতাম। এখন তো ঘর হয়েছে। গাছ-গরান চাষ করছি। আগে যে টাকা বাড়ি ভাড়া দিতাম সে টাকা দিয়ে পুলাপাইনরে এখন ভালভালাইয়া (ভালোমতো) খাওয়াই। পড়াশুনা করাই। কষ্ট শেষ, সুখে আছি। ছোট মেয়ে ক্লাস টেইনে পড়ছে। আমাদের ইচ্ছে ও বড় হয়ে সরকারি অফিসার হবে।’
দেখা গেলো, রিপন-রাহিমার ঘরে বৈদ্যুতিক ফ্যানের নিচে পড়াশোনা করছে তাদের বিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে। সাধ্যমতো আসবাবপত্রে সাজিয়েছেন ঘরের কক্ষগুলো। ঘরের বারান্দায় একপাশে কয়েকটি কয়েকটি খাঁচায় দেখা মেলে তিন জোড়া বাহারি কবুতরের। এরমধ্যে একজোড়া কবুতর ডিম ফুটিয়ে জন্ম দিয়েছে দুটি বাচ্চা। মাঝে মধ্যেই বাকবাকুম করে ডাকছে কবুতরগুলো।

রিপন বলেন, ‘আমি আগে অনেক কষ্টে ছিলাম। এখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিয়েছে। আগেতো নিজেরই থাকার জায়গা ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘এখন সব কষ্ট শেষ হয়ে গেছে। সুন্দরমতো চলতে পারছি। এখন নিজের থাকার জায়গা আছে। গাছ লাগাচ্ছি, কবুতর পালছি।’
শুধু রিপন-রাহিমা দম্পতি নয়, তাদের মতো পাল্টে গেছে এ আশয়ণ প্রকল্পের থাকা বাকিদের জীবনযাত্রাও। দুই একর আয়তনে প্রকল্পটিতে রয়েছে ৭৫টি ঘর। গত মার্চে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর ঘরগুলোকে গৃহহীনদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয় বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়।
বুধবার (১৬ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, শটিবনের পাড় প্রকল্পে মোট ৭৫টি ঘর রয়েছে। নদীর পাড়ে হওয়ায় বাড়ির পাশের জায়গায় বৃক্ষরোপণ করে সবুজে সাজাচ্ছেন উপকারভোগীরা। ঘরের আঙিনায় কেউ রোপণ করছেন ফলদ, কেউ বনজ গাছ। রয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা। ফাঁকা জায়গায় শিশুরা ফুটবল খেলছে। আমগাছে মুকুল এসেছে। ঢ্যাঁড়শ গাছে দুলছে কচি ঢ্যাঁড়শ।
সুখের হাওয়া গৃহিণী আঁখি ও কারখানা শ্রমিক উজ্জ্বলের ঘরেও। প্রকল্পের ৩৮ নম্বর ঘরে দেখা হয় তাদের সঙ্গে। ঘরের সামনে পুঁইশাকের চারা রোপণ করছিলেন উজ্জ্বল। ঘরের ভেতরে রয়েছে সেলাই মেশিন।
আঁখি আক্তার বলেন, ‘আগে অন্যের বাসায় থাকতাম, কষ্ট করে ভাড়া দিতাম। স্বামী যা আয় করতো তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলতো। নিজের বাড়ি হবে এটা কখনো চিন্তাও করতে পারতাম না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিয়েছেন। এখন ভাড়া দেওয়া লাগে না, লোকের কথাও শোনা লাগে না।’
তিনি বলেন, ‘এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে অনেক ভালো আছি। ও (স্বামী) বাইরে কাজ করে, আমি সংসারের কাজের পর সেলাই মেশিন চালাই।’
আশ্রয়ণ প্রকল্পে সাংবাদিক আসার খবরে এগিয়ে আসেন মো. আফজাল। প্রকল্পের ৫৬ নম্বর ঘরের সামনে নিয়ে যান তিনি। দেখান নিজের ঠিকানা, রোপণ করা কিছু গাছ।
উপকারভোগী আফজাল বলেন, ‘১৫-২০ বছর ভাড়া ছিলাম। আমরা দরিদ্র মানুষ। বাড়ি ভাড়ায় অনেক টাকা চলে যেতো। এখন আর সে চিন্তা করতে হয় না।’
আলমগীর নামের আরেকজন বলেন, ‘এখানে একটা সুন্দর জীবন পেয়েছি আমরা। আমাদের অনেকের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে। কেউ তাদের বলতে পারে না ভাড়াটিয়া কিংবা ওদের বাড়ি নাই।’
একই কথা বলেন প্রকল্পের প্রায় সবাই। জমিহীন-গৃহহীন এসব মানুষ বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেন সুখের বসবাসের কথা।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হাছিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতি পরিবার দুই শতাংশ জমি ও একটি ঘর পেয়েছে। সবুজায়নের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছে। তাদের জন্য আমাদের আরও পরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা করা হবে। সমবায় সমিতি করা হয়েছে। ফাঁকা জায়গাগুলোতে শিশুদের বিনোদনের জায়গা করা হবে। মসজিদ ও কবরস্থানও করা হবে সুযোগমতো।’
এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করার কথা জানান সদ্য যোগদান করা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফিফা খান। উপহারের ঘর পাওয়া মানুষদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তিনি।