যদিও বিএনপি ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ২০১৩-১৪ সালের মতো আবারও সারাদেশে জ্বালাওপোড়াও, সন্ত্রাসের পথ ধরে এগোচ্ছে। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনের মানুষদের এখনই সুসংগঠিত হয়ে এই ষড়যন্ত্র ও অপশক্তি রুখে দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিতে হবে।
একজন দক্ষ, সুচিন্তক, পরিশীলিত মননের অধিকারী রাষ্ট্রনায়কের কল্যাণেই একটি দেশ, একটি জাতি তার গৌরবময় পথ রচনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যেটি হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। ১৯৭১ এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় পুনর্গঠনের পথে সদ্য স্বাধীন দেশে পা রেখে ধীরে ধীরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার চিহ্নগুলো মুছে দিয়ে বাঙালি জাতির গৌরবগাথাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখন তথা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা ছিল বাঙালি জাতির জীবনে এক ভয়াবহ অভিশপ্ত কাল। যে সময়ে বাংলাদেশের বুক ক্রমাগত ক্ষত-বিক্ষত করে সামরিক শাসকদের শাণিত বেয়োনেট।
এক বুক রক্তক্ষরণের ভেজাপথ বেয়ে চলা বাংলাদেশ বারবার হোঁচট খেয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়াতে পারেনি। জাতি হিসেবে বাঙালির তখন ভয়াবহ কষ্ট ধারণ করে মুখ বুঁজে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বেদনায় জর্জরিত গণতন্ত্র, বিষণ্ণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আর রক্তাক্ত অসাম্প্রদায়িক মনোজগতের প্রতিস্তরে শুধু কষ্টের দাগ। এমন এক মৌলবাদতন্ত্রের সামরিকায়নের যাঁতাকল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ নতুন করে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর যেন পুনঃ স্বাধীনতা লাভ করে। জীবন্ত পোস্টারের সেই জগৎবিখ্যাত স্লোগান- ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক- গণথন্ত্র মুক্তি পাক’ এর অবিনশ্বর অঙ্গীকারে সিক্ত বাংলাদেশ যেন জিপিওর সামনের জিরো পয়েন্টে নতুন ভাবে লাল-সবুজের পতাকা হাতে এসে বুক ফুলিয়ে নিঃসংকোচে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তোলে কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়।
এটা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ আট বছরের অপশাসনের, দুঃশাসনের অবসানের অর্জন। কিন্তু ’৯১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আয়োজিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসে সিভিল ড্রেসের সামরিক শাসকেরই প্রতিচ্ছায়া। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নবোনা বাংলাদেশের নক্সীকাঁথা আবারও স্বাধীনতাবিরোধীদের কবলে নিপতিত হয়। এরপর একইভাবে অসহযোগ আন্দোলনে এই অপশক্তির পতন ঘটে আজকের সফল রাষ্ট্রনায়ক, প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। সময়টা ১৯৯৬ সাল। পতন ঘটে খালেদা জিয়া সরকারের। উল্লেখ্য, সেই আন্দোলনে আদমজী জুট মিল ও অন্যান্য শ্রমজীবী লাখো শ্রমিকের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
’৭৫ থেকে ’৯৬। এই ২১ বছরের দুঃসহ দেশ শাসনকালে যে শাসকরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, তারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে করেছে পদদলিত ও ভূলুণ্ঠিত। প্রগতিশীল চেতনার পতাকাকে দুমড়ে-মুচড়ে রেখেছে তোরঙ্গে তুলে। এর আগে বিদেশে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যায়। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন দুপুরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। কুর্মিটোলা বিমানবন্দর ঘিরে লক্ষ জনতা কাকভেজা হয়ে অবস্থান করেছিল। সেদিনের সেই বৃষ্টিভেজা দুপুরে নারায়ণগঞ্জ থেকে আমরাও সব বন্ধু গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন স্থল কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে তাঁর কন্যা দেশে ফিরবেন আর আমরা যাব না, সেটা কী হয়! আমরা ভিজে দাঁড়িয়েছিলাম টার্মিনালের একপাশে। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। ক্রন্দনরত সারা ঢাকার চোখেমুখে অপার বেদনার ছায়া। দুপুরের এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন হারা বাংলাদেশের মাটিতে যখন পা রাখেন, তখন কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের রানওয়ে, লাউঞ্জ আর টার্মিনাল হু হু করে কেঁদে উঠল বুকভাঙা কান্নায়। সেই কান্না ভেজা পথ ধরেই লাখো জনতার ভালোবাসা-বেদনায় ভিজতে ভিজতে বিয়োগ ব্যথায় ব্যথিত হয়ে তাঁর চেনা পথ, চেনা বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ালেও ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িটি তখনো সামরিক জান্তার করায়ত্তে ছিল অবরুদ্ধ।
৩২ নম্বরে তিনি ঢুকতে না পেরে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছেন আর তাঁর পিতা-মাতা-স্বজনদের জন্যে মহান রাব্বুল আল আমীনের কাছে দোয়া করেছেন। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বেদনাবিধুর এই দৃশ্যের কাছে পাথরও যেন কান্নার পানিতে ভিজে মোম হয়ে গলে পড়ছিল ৩২ নম্বরের চারপাশে। কী এক করুণ চিত্রগাথা। এ ভাবেই বৃষ্টি আর বঞ্চনা, কান্না আর স্বজন হারানো বুকভরা আর্তনাদ বিজড়িত ছিল বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সেই ঐতিহাসিক দিনটি।
ঐতিহাসিকই বটে। ১৯৮১-র ১৭ মে দেশে ফেরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ১৯৯৫ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফেরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা বন্ধের পথ উন্মুক্ত করে বিচার কার্য শুরু করেন। বিগত ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফিরে বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে এক বিভীষিকাময় রাষ্ট্রে পরিণত করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তখন ইতিহাসের ভয়ংকর আর বর্বরতম নারকীয় অবস্থা অতিক্রম করছিল। সে এক অবর্ণনীয়, বীভৎস পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন এই বীভৎসতা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য রাজপথে ধূলিময় পথে পথে বিচরণশীল। তখনই আবার আসে নিষ্ঠুরতম আঘাত। দিনটি ছিল ২১ আগস্ট।
রাষ্ট্রের আনুকূল্যে সেই গ্রেনেড হামলার আঘাতটি আসে সরাসরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। গ্রেনেড হামলায় তিনি বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। করুণ আর নিষ্ঠুর এই পথপরিক্রমার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় পুনরায় আরোহণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
সেই ২০০৯ থেকে ২০২২-এই তেরো বছরে পুরো বাংলাদেশটাকেই বদলে দিয়েছেন তিনি তিনবারের টানা প্রধানমন্ত্রী, মাদার অব হিউম্যানিটি, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, স্বপ্নবাদী সফল রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত হয়েছে, পেয়েছে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। সর্বোপরি দুর্নীতিসহ ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুন্দ্র বন্দর, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক ব্যবস্থার প্রভূত উন্নত সেবা, খাদ্য, বিদ্যুৎসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি ধরে রাখা, কোভিড-১৯কে সফলভাবে মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে এনে দাঁড় করিয়েছেন এক ইতিহাসের স্বর্ণশিখরে। দেশের এই উন্নয়ন অক্ষুণ্ণ ও অটুট রাখতে হলে জননেত্রীকে আবারও ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে হবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী করার মাধ্যমে।
যদিও বিএনপি ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ২০১৩-১৪ সালের মতো আবারও সারাদেশে জ্বালাওপোড়াও, সন্ত্রাসের পথ ধরে এগোচ্ছে। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনের মানুষদের এখনই সুসংগঠিত হয়ে এই ষড়যন্ত্র ও অপশক্তি রুখে দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের গৌরব আর উন্নয়ন থাকবে সমুন্নত। আর তাই ২০২৪ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বিজয়ী করে এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যেতে হবে। শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম- কোথাকার বাংলাদেশ আজ কোথায় এসে উপনীত হয়েছে! জাদুর কাঠি নয়, বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত, জনকল্যাণমুখী সরকার এবং সরকারপ্রধানের আন্তরিক আর নিরলস প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ আজ একটি উন্নত, সফল, গর্বিত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্বে।
লেখক : মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ, আইনজীবী