পাহাড়ের মাটিতে লটকনের ফলন বেশি ও লাভজনক

সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর

পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়-সমতলে প্রতি মৌসুমেই নানা রঙের ফুল, ফল ও শাক-সবজির উৎপাদন হয়ে থাকে। যা থেকে প্রয়োজনীয় খাবারের জোগানসহ পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। পাহড়ে জুম চাষের পাশাপাশি মৌসুমি হরেক রকম মিশ্র ফলের সঙ্গে পাহাড়ের কৃষকরা চাষ করছেন লটকন। পাহাড়ি অঞ্চলে মৌসুমের খুবই পরিচিত ফল লটকন। যদিও একটা সময় অপ্রচলিত ফলের তালিকায় ছিল এ লটকন। তবে লটকনের চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর জনপ্রিয়তাও বেশ বেড়েছে। টক-মিষ্টি স্বাদের হওয়ায় ইতোমধ্যে ফলটি সারাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

লটকন চাষে দিন দিন আগ্রহ বেড়েই চলছে পাহাড়ের চাষিদের মধ্যে। বাজারে এ ফলের ব্যাপক চাহিদা এবং দেশি ফলের প্রতি মানুষের আকর্ষণের পাশাপাশি খরচ কম ও অল্প সময়ে লাভজনক হওয়ায় বাড়ছে এই ফল চাষের আগ্রহ। কয়েক বছর আগেও এই সুস্বাদু ফলটির চাষে কৃষকদের তেমন আগ্রহ ছিল না। তবে ব্যাপক চাহিদা আর ভালো মুনাফা দেখে তিন-চার বছর ধরে পাহাড়ের চাষিরাও শুরু করেছেন এ ফলের চাষ। বাড়ির আশপাশে, অনাবাদি জমিতে চাষিরা এখন এই ফলের চাষ করছেন। এ ফলের আকার দুই থেকে পাঁচ সেমি হয় যা থোকায় থোকায় ধরে।

সরজমিন খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কৃষি গবেষণা হয়ে জামতলির প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, লটকন ফল পুরো গাছকে আগলে রেখেছে। গাছের গুঁড়ি থেকে শাখা-প্রশাখাও ফলে ফলে ছেয়ে গেছে। হলুদ রঙে লটকনে বাগানের গাছগুলো রঙিন হয়ে গেছে। পুরো এলাকায় এখন গাছভর্তি লটকন আর লটকন। লটকন চাষি লিলি খীসা বলেন, চলতি মৌসুমে তার লটকনের আবাদ বেশ ভালো হয়েছে। এছাড়া এখানকার লটকন অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক মিষ্টি হওয়ায় ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি হর্টিকালচারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মালেক বলেন, পাহাড়ে খুব কম খরচে লটকন চাষ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষে অনেক লাভবান হওয়া যায়। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় কয়েক বছর ধরে ব্যাপক পরিমাণে এর চাষ হচ্ছে। পাহাড়ের লটকন অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দ্বিগুণ সুস্বাদু ও সম্পূর্ণ ফরমালিনমুক্ত। পাহাড়ে লটকন গাছে গত বছরের মতো এবারো ভালো ফলন হয়েছে। চাষিরা প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকার লটকন বিক্রি করেছেন। এই লটকনের বাগানের টাকায় অনেকেই সংসার চালাচ্ছেন।

জানা যায়, প্রতিদিন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও শহরের আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতার আগমন ঘটে এখানে। এই এলাকার লটকন সুস্বাদু হওয়ায় দেশব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। পাইকাররা এখানকার চাষিদের কাছ থেকে লটকন কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নিয়ে বিক্রি করে থাকে। চলতি মৌসুমের শুরুতে ১২০ থেকে ১০০ টাকা এবং বর্তমান ভরা মৌসুমে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে লটকন বিক্রি করেছেন বলে জানান চাষিরা।

খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানিদের তথ্য মতে, পুষ্টিগুণে অনন্য এবং অনেক ধরনের উপকারিতাও রয়েছে এ ফলটির। এতে ভিটামিন ও খাদ্যশক্তিসহ নানারকম খনিজ উপাদান রয়েছে। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে, দিনে দুতিনটি লটকন খেলে শরীরের ভিটামিন সির চাহিদা পূরণ হয়। এছাড়াও রয়েছে নানা রকম পুষ্টি উপাদান যা শরীরকে সুস্থ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রুচি বাড়াতে লটকন বেশ উপকারী। ভিটামিন সি, ত্বক, দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে। এই ফলে নানা রকম খনিজ উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম উল্লেখযোগ্য।

এসব উপাদান শরীরকে সুস্থ রাখে। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্রোমিয়াম থাকে। রক্ত ও হাড়ের জন্য বিশেষ উপকারী আয়রন। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ৫.৩৪ মি.গ্রা আয়রন থাকে।

লটকনে ভিটামিন বি পাওয়া যায়। প্রতি ১০ গ্রাম লটকনে ১০.০৪ মি.গ্রা ভিটামিন বি ওয়ান ও প্রতি ১০০ গ্রামে ০.২০ মি.গ্রা ভিটামিন বি টু পাওয়া যায়। খাদ্যশক্তির ভালো উৎস লটকন। দেহ সক্রিয় রাখতে ও দৈনন্দিন কাজ করতে খাদ্যশক্তি প্রয়োজন হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ৯২ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায় যা আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

লটকনে রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড ও এনজাইম যা দেহ গঠন ও কোষকলার সুস্থতায় কাজে লাগে। এইসব উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। লটকনে কিছু পরিমাণে প্রোটিন ও ফ্যাট পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ১.৪২ গ্রাম প্রোটিন ও ০.৪৫ গ্রাম ফ্যাট থাকে। লটকন একটি ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল, এতে ভিটামিন সি থাকায় চর্মরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

লটকন গা গোলানো ও বমি বমিভাব দূর করতে পারে। পাশাপাশি মানসিক অবসাদ দূর করতেও সাহায্য করে। এছাড়াও গরমে তৃষ্ণা মিটাতে লটকন খাওয়া যায়, কারণ এতে জলীয় অংশের পরিমাণ বেশি। ফলের পাশাপাশি লটকনের পাতাও ওষুধির কাজ করে। এর পাতা ও শিকড় খেলে পেটের নানারকম অসুখ ও জ¦র ভালো হয়ে যায়। লটকনের বীজ গনোরিয়া রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ডায়ারিয়া দূর করতে লটকনের পাতার গুঁড়া বেশ ভালো ফল দেয় বলেও জানা গেছে।