এক সময় দেশে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ ছিল জীবন। দেশজুড়ে ছিল লোডশেডিংয়ের দুঃসহ যন্ত্রণা। ১৫ বছর আগের সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই।
দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুতায়ন হয়েছে সব শহর, গ্রাম, চর, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। কোথাও এখন আর আঁধার নেই। শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে ঠাকুরগাঁও জেলাও।
গত ১৫ বছরে এই জেলায় নতুন করে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কি.মি বিদ্যুতের সার্ভিস লাইন বিস্তৃত হয়েছে। এই সময়ে জেলাটিতে বিদ্যুতের গ্রাহক বেড়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার। অর্থাৎ ৩ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছেন।
পূর্বে এই জেলায় মাত্র ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ১০৪ মেগাওয়াট। জেলায় ২০২২ সালে ইপিভি ঠাকুরগাঁও লিমিটেড নামের নতুন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। পিকআওয়ারে জেলাটিতে বিদ্যুতের চাহিদা ১০৪ মেগাওয়াট হলেও এই কেন্দ্রটির উৎপাদন ১১৫ মেগাওয়াট।
নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর আরও বদলে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি। কালে-ভ্রদ্রে লোডশেডিং হলেও নেই লো ভোল্টেজ। আগের চেয়ে আরও বেশি আলোকিত এখন ঠাকুরগাঁও।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় ২০২২ সালে ১১৫ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির নানামুখি উদ্যোগের ফলে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ থেকে নেসকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই এ জেলার শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
২০০৬ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো মাত্র ৩০ মেগাওয়াট। বর্তমানে জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ১০৪ মেগাওয়াট। ২০০৬ সালে মাত্র ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল, বর্তমানে শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ সেক্টরে ৮০১২.২৪ কি.মি. দীর্ঘ সার্ভিস লাইন রয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ে। ২০০৬ সালে যা ছিল মাত্র ৩৬১৮.২১ কি.মি. বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ে বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৪ লাখ ১৮ হাজার ৯১ জন গ্রাহক বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। ২০০৬ সালে বিদ্যুৎ গ্রাহক মাত্র ৯১ হাজার ১১২ জন।
২০২২ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের গৌরীপুর ইপিভি ঠাকুরগাঁও লিমিটেড নামের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কাজ শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১৫ মেগাওয়াট। প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তও। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১৫ একর জমির ওপর অবস্থিত।
সরেজমিনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেছে, পুরোদমে চলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজ।
কথা হয় ইপিভি ঠাকুরগাঁও লিমিটেড ম্যানেজার (অপারেশন) মো. জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০২২ সালের মার্চে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয়েছে। এর ক্যাপাসিটি ১৩২ মেগাওয়াট। পুরো ঠাকুরগাঁওয়ের পিকআওয়ারে চাহিদা ১১৪ মেগাওয়াট, আর আমাদের উৎপাদন ১১৫ মেগাওয়াট।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ ২০১৯ সালে শুরু হয়। করোনার কারণে মাঝে কাজ বন্ধ ছিল। পরে ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় এর বাণিজ্যিক উৎপাদন।
তিনি আরও বলেন, এখানে প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি রয়েছেন। বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রংপুর বিভাগ ও ঠাকুরগাঁওয়ের নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এখানে স্থাপিত হওয়ায় এলাকার বেশ কিছু মানুষের এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি যখন ঠাকুরগাঁও আসি তখন আমার বাসায় ফ্যান ঘুরতোনা, ফ্রিজ চালানো যেত না; ভোল্টেজ কম ছিল। এই প্ল্যান্ট চালু হওয়ার পর এখানে আর ভোল্টেজের সমস্যা নেই।
ঠাকুরগাঁওয়ের বাসিন্দা সানোয়ার পারভেজ পুলক বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর এখানকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আগের চেয়ে এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। ভোন্টেজ আগের চেয়ে হাই। বিদ্যুৎ তেমন যায় না। আর আগে সবার ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। এখন প্রায় সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী হরিণমাড়ী এলাকার বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগেও এলাকার সবার ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। এখন প্রায় সবার ঘরেই বিদ্যুৎ আছে। এলাকায় আগের চেয়ে বিদ্যুতের অবস্থা বেশ ভালো। তবে লোডশিডিং এখনও রয়ে গেছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহাবুবর রহমান বলেন, ১৫ বছর আগে এখানকার ৬০ ভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিলেন। এখন শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছেন। বিদ্যুতের বাইরে এখন আর আমাদের কেউ নেই। এখানে ২০২২ সালে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এর উৎপাদন ক্ষমতা ১১৫ মেগাওয়াট, ঠাকুরগাঁওয়ের যে চাহিদা তারচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এখানে।
তিনি বলেন, এখানকার বিদ্যুৎ অন্যান্য কেন্দ্রের মতো জাতীয় গ্রিডে যায়, সেখান থেকে পরে ওই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার ফলে এখানকার গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সেবা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই জনপদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র এ এলাকার জন্য আশির্বাদ হিসাবে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, জেলার প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি কল-কারখানায়, প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ সব জায়গায় বিদ্যুৎ রয়েছে। ঠাকুরগাঁও এখন আগের চেয়ে বেশি আলোকিত।