দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক। ট্রাউজার, টি-শার্ট ও নিটওয়্যার, সোয়েটার, শার্টস ও ব্লাউজ এবং আন্ডারওয়্যার—হাতে গোনা এ পাঁচ পণ্য পাঠিয়েই আসে ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ। এর মধ্যে টি-শার্ট থেকেই আসে প্রায় ২২ শতাংশ। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, শুধু টি-শার্টে ভর করেই অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী ভারত ও ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০১৭ সালে টি-শার্ট রফতানি হয়েছিল ৬৬৫ কোটি ডলারের মতো। ২০২২ সালে হয় ৯৮৬ কোটি ডলারের। অর্থাৎ এ ছয় বছরের ব্যবধানে টি-শার্ট রফতানি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে পোশাক পণ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যাপারেল রিসোর্সের তথ্যে দেখা যায়, ভারত থেকে ২০১৭ সালে টি-শার্ট রফতানি হয়েছিল ২৭২ কোটি ডলারের। ২০২২ সালে তা বাড়েনি, বরং ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ কমে ২৫১ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে দেশটি। এদিকে একই সময়ের ব্যবধানে নিট পোশাকটির রফতানি বাড়লেও বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি ভিয়েতনাম। ২০১৭ সালে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশটি বিশ্ববাজারে ২০৮ কোটি ডলারের টি-শার্ট রফতানি করে। ২০২২ সালে তা ৩৪ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে ২৮০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ, ভারত ও ভিয়েতনামে তৈরি টি-শার্ট বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে ভারত ও ভিয়েতনাম নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে কটনভিত্তিক টি-শার্টে ভালো করতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশে তৈরি এ পোশাক পণ্যের গুণগত মানের পাশাপাশি রয়েছে হোসিয়ারি ও নিটওয়্যার পণ্যের ঐতিহ্যগত দক্ষতা। সুলভ শ্রমের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সে দক্ষতা কাজে লাগিয়েই রফতানির অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে তৈরি পোশাক খাতের টি-শার্ট পণ্য।
বাংলাদেশের নিটওয়্যার পণ্যের অন্যতম বৃহৎ গ্রুপ মাইক্রো ফাইবার। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (অর্থ) ড. কামরুজ্জামান কায়সার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টি-শার্টে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশ পিছিয়ে থাকার কারণ হলো নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজটা শক্তিশালী। আমাদের শ্রম ব্যয় চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের চেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। বাংলাদেশ দক্ষতায়ও ভারতের চেয়ে ভালো। আমাদের এফিশিয়েন্সি ও অটোমেশন অনেক উন্নত। আমরা বড় ভলিউমে কাজ করি এবং এক্ষেত্রে সক্ষমতায় অনেক দেশের চেয়ে ভালো।’
কামরুজ্জামান কায়সার আরো বলেন, ‘নিটওয়্যার ও হোসিয়ারি শিল্পে বহু আগে থেকেই আমরা সিদ্ধহস্ত। ঐতিহাসিকভাবে ধারণ করছি। পর্যায়ক্রমে এ ধরনের পণ্যে আমরা আরো উন্নত হচ্ছি। কাজের নিপুণতার একটা বিষয় আছে। টি-শার্ট পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেটি অর্জন করেছে। মানের দিক থেকেও মেড ইন বাংলাদেশের সঙ্গে পেরে উঠছে না অনেক দেশ। তাই ক্রেতার কাছে এ দেশের পণ্য ভারত বা ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। আবার ওভেন পণ্যে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত তুলনামূলক ভালো।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহ্যগত দক্ষতা ও উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতার কেন্দ্র হলো পণ্যের দাম। কম মূল্যের শ্রমের কারণেই বাংলাদেশে কটনভিত্তিক টি-শার্টের দাম অনেক দেশের চেয়ে ভালো। অ্যাপারেল রিসোর্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে তৈরি টি-শার্টের গড় মূল্য ছিল ২ ডলার ৬৯ সেন্ট। একই পণ্যের গড় মূল্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২ ডলার ৬০ সেন্ট। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে সক্ষমতা অনেক ভালো থাকায় বাংলাদেশের লাভ বেশি। কেননা নিটওয়্যার পণ্যের প্রয়োজনীয় সুতার ৯০ শতাংশই অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে।
নিটওয়্যার পোশাক শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের টি-শার্ট চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় ভালো। এর কারণ হলো বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বের সবচেয়ে ভালো তুলা ব্যবহার করে। চীন ও ভারত ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব তুলা, যা কিছুটা নিম্নমানের। ভিয়েতনামও তুলার জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে ভালো তুলা ব্যবহার করে, এখানকার সুতার মানও অনেক উন্নত। একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো মানের নিটিং মেশিন ব্যবহার করা হয়। ডায়িংয়ের ক্ষেত্রেও এ দেশের কারখানাগুলোর মেশিন অনেক উন্নত। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের পণ্যের মান ন্যূনতম ভালো মানদণ্ডের নিচে নামার কোনো সুযোগ নেই। সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের টি-শার্টে একটা ঐতিহ্যগত দক্ষতা ও প্রেক্ষাপট রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি মনে করি, মানের দিক থেকে টি-শার্টে বিশ্বের এক নম্বর হলো বাংলাদেশ। মূলত কটনভিত্তিক টি-শার্টে অনেক দেশের চেয়েই ভালো। ভ্যালু অ্যাডেড বা ম্যান মেড টি-শার্টের ক্ষেত্রে অবশ্য ভিয়েতনামের দক্ষতা তুলনামূলক ভালো। কিন্তু এক্ষেত্রে সক্ষমতার প্রায়োগিক একটা দিক রয়েছে। তাছাড়া আমরা যখন টি-শার্ট তৈরি করছি সেটা শুধু রফতানির উদ্দেশ্যেই করছি। স্থানীয় পর্যায়ে সেই টি-শার্টের ব্যবহার নেই। কিন্তু ভারত এত বড় দেশ, তাদের স্থানীয় বাজার নিয়েও ভাবতে হয়।’
জানা গেছে, বিশ্ববাজারে পোশাক বিক্রির পরিমাণ বছরে ১ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। এ বাজারে স্বল্পমূল্যের টি-শার্ট যেমন আছে, তেমনি আছে উচ্চমূল্যের ওভারকোট, স্যুট ও ডেনিম জ্যাকেট। তবে বড় অংশজুড়ে আছে টি-শার্ট। পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলো বছরে ৪৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি টি-শার্ট রফতানি করে। পণ্যটির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া টি-শার্টের সিংহভাগই হয় নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা নিট পোশাকের কারখানাগুলো থেকে।
সতেরো-আঠারো শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজ ও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের আগমনের পর গুরুত্ব বাড়ে নারায়ণগঞ্জের। ১৯২৭ সালে শীতলক্ষ্যা তীরে সূর্য কুমার বোস গড়ে তোলেন ঢাকেশ্বরী কটন মিল। ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠা পায় চিত্তরঞ্জন কটন মিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণগঞ্জকে রূপান্তর করা হয় পাট শিল্পের কেন্দ্রে। কালক্রমে পাটের পরিবর্তে আধিপত্য বাড়ে তুলাজাত সুতার। একপর্যায়ে ঢাকার পাশের এ বাণিজ্যিক জেলা দেশের প্রধান হোসিয়ারি উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
নিট পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের শীতলক্ষ্যা নদীতীরে অবস্থিত টানবাজার দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি তুলাভিত্তিক সুতার বাজার। বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু সুতা ব্যবসায়ীরা এখনো তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার শেষার্ধে নারায়ণগঞ্জে উৎপাদিত সুতা ও কাপড়ের খ্যাতি সারা বিশ্বে এমন একটি স্তরে পৌঁছে যে তৎকালে এ অঞ্চলকে ‘ম্যানচেস্টার অব এশিয়া’ বলা হতো। ভৌগোলিক অবস্থান ও টি-শার্ট তৈরিতে ব্যবহৃত সুতার শত শত বছরের পুরনো ইতিহাসই এ অঞ্চলকে বর্তমানে টি-শার্টের বৈশ্বিক কেন্দ্র বা হাবে পরিণত করেছে। এখন অবশ্য নিট পোশাক শিল্পের পরিধি বেড়েছে। জ্বালানি, যোগাযোগ, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার কারণে কারখানা ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।