অনুমোদনের অপেক্ষায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পর সরকারের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ। এই লক্ষ্য অর্জনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : আইসিটি মাস্টারপ্ল্যান-২০৪১’ শিরোনামে একটি খসড়া তৈরি করেছে। খসড়াটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের আশা, খসড়ায় কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে, সেই পরিবর্তন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অচিরেই এটি অনুমোদন পাবে। আর সরকারের চলতি মেয়াদেই কাজ শুরু হবে।

মহাপরিকল্পনার সূচনায় বলা হয়েছে, ২০২১ সাল নাগাদ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট ও অতিদরিদ্রহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মার্চ মাসে এ খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়, আর চলতি বছরের মার্চে এটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

মহাপরিকল্পনায় চারটি বিষয়কে মূলভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলো স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। এ ছাড়া ‘বাংলা স্ট্যাক’ নামে তিন স্তরের একটি বিষয়কে এই মহাপরিকল্পনার মেরুদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করছে আইসিটি বিভাগ।

স্মার্ট সিটিজেন : স্মার্ট সিটিজেন বা নাগরিকদের স্মার্ট করে গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনায় কিছু রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে আছে নাগরিকদের শতভাগ ডিজিটাল অবকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, সবার জন্য ইউনিভার্সাল ডিজিটাল আইডি বা সর্বজনীন ডিজিটাল পরিচিতি তৈরি করা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুনরায় দক্ষতা প্রশিক্ষণ দেওয়া, ডিজিটাল সহায়তা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ প্রচার পরিচালনা অন্যতম।

স্মার্ট সোসাইটি : স্মার্ট সোসাইটি বা স্মার্ট সমাজ গড়ে তুলতে চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই মাস্টারপ্ল্যানে। এর মধ্যে আছে সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, সবুজ টেকসই বাংলাদেশ গঠন, ডিজিটাল সহনশীলতা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং স্মার্ট বাংলাদেশ ‘স্ট্যাক’ বাস্তবায়ন। এর মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ স্ট্যাক তথা ‘বাংলা স্ট্যাক’ বিষয়টিকে এই মহাপরিকল্পনার ‘ব্যাকবোন’ বা মেরুদণ্ড হিসেবে ধরা হয়েছে।

স্মার্ট ইকোনমি : এ ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। এর মধ্যে আছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি ত্বরান্বিত করা, স্টার্টআপ বাংলাদেশ এবং স্মার্ট কমার্স গড়ে তোলা এবং প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করা। এসব মূল বিষয়ের মধ্যে আছে আইসিটি খাতকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত করা, ‘ইজ অব ডুইং বিজনেস’ সূচকে উন্নতি এবং ‘সার্কুলার ইকোনমি’ গড়ে তোলা।

স্মার্ট গভর্নমেন্ট : এই মহাপরিকল্পনায় সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্মার্ট গভর্নমেন্ট বা স্মার্ট সরকার গড়ে তোলাতে। এর মধ্যে আছে স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট ডাক সেবা, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বিচার বিভাগ, স্মার্ট সীমান্ত, স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা, স্মার্ট কর ব্যবস্থা, সরকারি ক্রয়ে ই-মার্কেটপ্লেস, ডিজিটাল চাকরি মাধ্যম, স্মার্ট জনসেবা ও ‘পেপারলেস’ বা কাগজহীন প্রশাসন, পুলিশের আধুনিকায়ন, আইসিটি নীতিমালা প্রণয়ন, ডিজিটাল লিডারশিপ একাডেমি এবং স্মার্ট পরিকল্পনা। এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ সাল নাগাদ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি সৃজনশীল দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া এবং শতভাগ সরকারি অফিসে পেপারলেস ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ আইসিটি বিভাগের।

বাংলা স্ট্যাক : আইসিটি বিভাগ বলছে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অদৃশ্য মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করবে ‘বাংলা স্ট্যাক’। এর তিনটি স্তরে রয়েছে ‘আইডেন্টিটি’ বা পরিচয়, ‘পেমেন্ট’ বা মূল্য পরিশোধ এবং ডাটা বা তথ্য। এই তিনটি স্তরের মাধ্যমে বাসস্থান, পরিবহন ব্যবস্থা, ফিন্যান্স, বিচার ব্যবস্থা, নিবন্ধন প্রক্রিয়া, শিক্ষা, কর ও কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, সামাজিক সেবা, কমিউনিটি এবং স্বাস্থ্যসেবাকে স্মার্ট করে গড়ে তোলা হবে। এই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, একজন মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুই এ বিষয়গুলোতে উঠে এসেছে।

মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বাংলা স্ট্যাক বাস্তবায়িত হলে সরকারি ও বেসরকারি সেবায় নাগরিকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ডিজিটাল সেবা পাবে এবং তাদের তথ্যের বিষয়ে তাদের কাছেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। পাশাপাশি সরকার একই তথ্য একাধিক স্থানে সংরক্ষণ করার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি, একই তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যবহারের উপযোগিতা অর্জন এবং তাৎক্ষণিক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘রিয়েল টাইম ডাটা’ পাবে সরকার। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ের সেবাদাতারা তাদের গ্রাহকদের আরও অধিকতর উন্নত সেবা দ্রুত দিতে পারবে বলেও মহাপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ : আইসিটি মাস্টারপ্ল্যান-২০৪১’ সম্পর্কে আইসিটি বিভাগের উপসচিব মো. মনির হোসেন কালবেলাকে বলেন, এ মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে শুধু আইসিটি বিভাগের পক্ষ থেকে। এটা সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার জন্য না। আবার একা আইসিটি বিভাগ কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ জন্য কিন্তু সবাইকে তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। এই পরিকল্পনা একটা গাইডলাইনের মতো কাজ করবে। অন্যান্য সংস্থা এই গাইডলাইন মেনে তাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। আমাদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলো অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন ‘স্মার্ট সীমান্ত’ কিন্তু আইসিটি বিভাগ বাস্তবায়ন করবে না বরং এর সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) আরও অনেক সংস্থা জড়িত। এভাবে সব সংস্থা নিজেদের মতো করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে কাজ করবে। মনির হোসেন বলেন, মাস্টারপ্ল্যানটি খসড়া পর্যায়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।