আশ্রয়ণ প্রকল্প কেন শেখ হাসিনার মেধাসম্পদ

আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি মেধাসম্পদের স্বীকৃতি পেয়েছেন। সাধারণ অর্থে মেধাকর্ম এবং মেধাসম্পদের প্রচলিত ধারণায় আমরা সৃজনশীল কর্ম হিসেবে সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকর্ম, গান, নাটক, লিখিত বই, চলচ্চিত্র, শব্দ, রেকর্ডিং, মাল্টিমিডিয়া ও সফটওয়্যার ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকে মেধাজাত কর্ম হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। তা হলে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প কীভাবে মেধাসম্পদ এবং শেখ হাসিনা কীভাবে সেই মেধাসম্পদের অধিকারী? সংগত কারণেই এ প্রশ্নের অবতারণা স্বাভাবিক। এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে দেখা যাক মেধাসম্পদ কী।

মেধাসম্পদের ধারণাটি মূলত ১৬০০ শতাব্দীতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন তথা শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে পরিচিতি পেতে থাকে। অর্থনীতিতে সম্পদ বলতে যার উপযোগিতা রয়েছে এবং চাহিদা মেটাতে সক্ষম সেটিই সম্পদ। কিন্তু মেধাসম্পদের ধারণাটি ব্যাপক এবং বিস্তৃত। সময়ের বিবর্তনের ধারণা ও আওতা পরিবর্তিত হতে থাকে। সাধারণ অর্থে মেধাসম্পদ হলো, এমন সব বস্তুর ওপর আইনগত অধিকার, যা বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকরণের ফলে সৃষ্ট। মূলত মানুষ তার সৃষ্টিশীলতা, বিবেক, বুদ্ধি অনুশীলন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে যে সম্পদ তৈরি করে তাই মেধাসম্পদ। এই সম্পদকে অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।

নির্মাণের চেয়ে সৃষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষ যা রচনা করে তাকে বলা হয় ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বা বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ। মেধাসম্পদ বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে অস্থাবর, যা অন্য একটি স্থাবর সম্পদে নিহিত থাকে। অর্থাৎ মেধাসম্পদের অধিকার ওই দ্রব্য বা কপি নয়, বরং দ্রব্যসামগ্রীকে মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরকারী উদ্ভাবনী তথ্য বা কৌশল।

আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন থেকেই তিনি ভূমিহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নানবিধ কর্মসূচি ঘোষণা করছিলেন। তার বক্তৃতা, লেখা এবং গণমাধ্যমে এসবের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তার এই কল্যাণমুখী চিন্তা থেকেই উৎসারিত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি, যা দৃশ্যমান হচ্ছে ক্রমাগত। তার মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প ছিল মহতী এবং নব-উদ্ভাবিত কল্যাণমূলক চিন্তাজাত উদ্ভাবনী এক কর্ম।

১৯৯৭ সাল থেকে এই প্রকল্পের শুরু, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্য দূরীকরণ, জীবনমানের উন্নয়ন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ২৮ লাখ মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সহযোগিতায় একই মডেল অনুসরণের মাধ্যমে সর্বমোট ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ আশ্রয় পেয়েছে।

আশ্রয় পাওয়ার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের স্বাধীনতা, নারীর কর্মসংস্থান, জমি ও ঘরের নিজস্ব মালিকানা নিশ্চিত হয়েছে। একটি ভাসমান পরিবার, একজন বিধবা, সহায়-সম্বলহীন নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলার এই মহতী কর্ম একেবারেই শেখ হাসিনার মৌলিক চিন্তিাপ্রসূত। বাস করার জন্য শুধু দুটি কক্ষই নয়, সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন সুবিধা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। প্রকল্পের নাম বিবেচনায় নিলে শুধু দুটি কক্ষবিশিষ্ট ঘরই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একটি পরিবারের জীবনযাপনের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টির এই উদ্ভাবন শেখ হাসিনার মেধাজাত। খুব স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এটি আর দশটি প্রকল্পের মতো গতানুগতিক প্রকল্প নয়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি সুস্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা অনুকূল পরিবেশ, সুশিক্ষা, তথ্য ও সাংস্কৃতির সমুন্নত বিকাশ নিশ্চিত করা না যায়। মেধাসম্পদ এসব সুযোগ আর অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। আশ্রয়ণ প্রকল্পের দর্শন ব্যক্তিস্বাধীনতায় অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। সর্বশেষ রাষ্ট্রীয় সমীক্ষায় আমরা দেখছি, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যা শতকরা ১০ ভাগ থেকে ৫ দশমিক ৮-এ নেমে এসেছে, যা মূলত আশ্রয়ণের নানামুখী উদ্যোগের কারণে।

কেন কপিরাইটের আওতায় এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের মডেলকে নিবন্ধিত করতে হলো। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, মেধা বিকাশের স্বার্থে মেধাসম্পদ সুরক্ষা অপরিহার্য এবং মেধাসম্পদ সুরক্ষার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বহুপক্ষীয় ও বহুমাত্রিক। যার সুবিন্যস্ত রূপরেখাই কপিরাইট আইন, ট্রেডমার্কস আইন, পেটেন্ট আইন, ট্রেডসিক্রেট আইন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন ও ভৌগোলিক নির্দেশক আইন ইত্যাদি। দেশে দেশে যার প্রকাশ এবং প্রয়োগে ভিন্নতা থাকলেও উদ্দেশ্য একই মেধাসম্পদের অধিকার নিশ্চিত করা।

মূলত কপিরাইট আইনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো যেকোনো মৌলিক সৃজনশীল কর্মের স্বীকৃতিদানের ব্যবস্থা করা; দ্বিতীয়ত, যেকোনো মৌলিক সৃষ্টিকর্ম ও তার প্রণেতার আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং তৃতীয়ত, কোনো সৃষ্টিকর্মের মূল প্রণেতার মালিকানা স্বত্ব বা সৃষ্টিকর্মের ওপর একচেটিয়া অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মৌলিক সৃষ্টিকর্ম একটি মেধাস্বত্ব বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি, এই সম্পত্তি রক্ষার জন্য কপিরাইট আইনের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত কপিরাইট আইনের বিধান অনুযায়ী মূল প্রণেতা জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত সৃষ্টিকর্মটির কপিরাইট বা মালিকানা স্বত্ব তার মৃত্যুপরবর্তী বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

লেখকের অনুমতি ছাড়াই গল্পের বই বের করা, কোনো অনুষ্ঠানের উপস্থাপিত নাচ বা গান রেকর্ড করে বাইরে বিক্রি করা, কোনো বিখ্যাত শিল্পীর চিত্রকর্ম অনুমতি ছাড়াই বইতে ছাপানো, প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্র্যান্ডের পণ্যের নকল বাজারজাতকরণের মাধ্যমে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীর অধিকার ক্ষুণ্ণ ঘটছে অহরহ। কিন্তু কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এই নকল প্রবণতার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় না। অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে একটি উদ্ভাবন বা ধারণা মেধাসম্পদ, তবে যখন তা কপিরাইট বা অন্য কোনো অবয়বে নিবন্ধিত হয়, তখন তা মেধাসম্পদ অধিকার। উদাহরণস্বরূপ একটি মৌলিক গ্রন্থ মেধাকর্ম আর কপিরাইট হচ্ছে মেধাসম্পদের রচয়িতার আইনগত অধিকার। এখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মডেল বা কর্মসূচি শেখ হাসিনার মেধাসম্পদ এবং যখন তা মেধাসম্পদ আইনের আওতায় নিবন্ধিত হলো, তখন এটি তার আইনগত অধিকার।

কপিরাইটভুক্ত সম্পদটির মালিক এটিকে আইনের আওতায় নিজে ব্যবহার করতে পারবেন, একই সঙ্গে অন্যকেও ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সম্পদের বৈশিষ্ট বিবেচনায় সম্পদটির মালিক যেভাবে ইচ্ছা তার সম্পদটি ব্যবহার করতে পারেন, অন্য কেউ সম্পদের স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ব্যতীত তা ব্যবহার করতে পারেন না। কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধিত হয়ার পর শেখ হাসিনা এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী। এটি সৃজনশীল কর্মের প্রণেতার বা স্বত্বাধিকারীর সৃজনশীল কর্মের স্বত্বের অংশ।

বাংলাদেশ বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার সদস্য হওয়ায় কপিরাইট সনদ বিশ্বের যেকোনো দেশে ওই দেশের প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ও নৈতিক অধিকার সংরক্ষণ করে। মেধাবী মানুষের মেধাজাত কর্ম আইনসম্মতভাবে প্রাপ্ত অধিকারসমূহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই কারণে বিদেশি বই-পুস্তক দেশে পুনঃপ্রদর্শন, পুনর্মুদ্রণ পুনরুৎপাদন, চলচ্চিত্র ও ভিডিও ফিল্মের পুনঃপ্রচার, পুনঃপ্রদর্শন, কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার ব্যবহার ও হস্তান্তর ইত্যাদি কার্যাবলি কপিরাইট আইনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই অধিকার যদি অন্য কেউ অবৈধভাবে ভোগ করে, তাহলে কপিরাইট আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেল এখন দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত এবং প্রশংসিত। এমনকি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ইতিবাচক প্রভাব কয়েকটি দেশে অনুসরণের জন্য সক্রিয়ভাবে বিবেচিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মডেল অনুসরণে যেকোনো দেশের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সে বিবেচনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মেধাসম্পদের এহেন স্বীকৃতি হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী মাইলফলক।

লেখক: মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক