সংকটে বাজেট ও আগামী অর্থনৈতিক রূপরেখা

সংসারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হলে মায়েরা কেমন করে সংসারের বাজেট করেন তা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সব পরিবারের মোটামুটি পরিচিত একটি বিষয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার সব সময় একই রকম অবস্থার ভেতর দিয়ে যায় না। অর্থনৈতিক উত্থান পতন কোনও না কোনও সময়ে সেখানে আসে।

এবারের একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী বাজেট তৈরি নিয়ে যে কথা বলেছেন, তার যতটুকু পত্রপত্রিকায় এসেছে- তা থেকে মনে হচ্ছে, সংসারকে বাঁচানোর একটা বাজেটই তিনি করতে বলেছেন। বাস্তবে এ বছরের বাজেটটি অনেক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু যে নির্বাচনি বছর সেজন্য নয়, দেশের অর্থনীতি অনেক দিক থেকে সংকটে। তাই সংকটকালীন ও উত্তরণের রূপরেখা দুই-ই দাবি রাখে এ বাজেটে।

এবারের এই এক বাজেটেই যে দেশ এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসবে এমনটি বলার কোনও সুযোগ নেই। যেকোনও দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্যে কমপক্ষে দুই তিন বছর সময় দিতে হয়।

তবে এ কথা সত্য, সংকটকে উপলব্ধি করে এবারেই প্রথম বাজেট করার নির্দেশ এসেছে। এই নির্দেশ আরও আগে এলে ভালো হতো কিনা, সে প্রশ্নে এখন আর গিয়ে লাভ নেই। কারণ যে বিষয়টি অতীত হয়ে গেছে- তাকে নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ কি! যেমন কোভিড-১৯-এর মধ্যে যখন অনেক কিছু খরচ না বাঁচিয়ে বাজেট দেওয়া হচ্ছিল, সে সময়ে বারবার টেলিফোনে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছি সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে। আলোচনার বিষয় ছিল, করোনার ভয়াবহতা অবধি অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি ছয় মাসের বাজেট দেওয়া যায় কিনা, তারপরে করোনা পরবর্তী অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সময়ের জন্যে আবার একটি বাজেট দিলে কেমন হয়? তিনিও ছয় মাসের জন্যে প্রথম বাজেটটা করার পক্ষে ছিলেন।

যাহোক, করোনা পরবর্তী অর্থনীতির পরিবর্তন, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সঞ্চয় চলে যাওয়া। ব্যাংক ঋণে শিল্পের স্বার্থে ৯% ক্যাপ বসিয়ে দেবার ফলে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে সেভিংসের সুদ হার। সাধারণ মানুষের সেভিংসের সুদ কমে মূলত মুদ্রাস্ফীতির নিচে নেমে আসার ফলে সাধারণ কর্মজীবী মানুষ যে সংকটে পড়েছে তা এখন স্পষ্ট।

অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়া অনেকটা স্বাভাবিকই ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ না হলেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়তো। কারণ, ৭৩ ও ৭৪ পরবর্তী সময়ে যেমন পশ্চিমা দেশগুলোতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবার ফলে জ্বালানি তেল উৎপাদক দেশগুলো সেই সুযোগ নিয়েছিল, তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমনটি যে করোনা বা ইউক্রেন যুদ্ধ না হলেও পৃথিবীতে ঘটতো- তা করোনার আগের থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কারণ চায়না, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো জনবহুল দেশগুলো শুধু নয়, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ পৃথিবীর ছোট বড় দেশগুলোতে জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা তখনই বেড়ে গিয়েছিল ৩০%-এর বেশি। এমনকি, কৃষি থেকে শুরু করে সবকিছুই এনার্জি নির্ভরতার দিকে যাচ্ছে। পেপার লেস পৃথিবীও এনার্জির ওপর নির্ভর করেছে। অর্থনৈতিক ও জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনের দ্রুত চলাচল পৃথিবীতে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে আকাশ পরিবহন। তাই সব মিলিয়ে জ্বালানির দাম বাড়বে এটাই ছিল স্বাভাবিক। গত তিন চারটি বাজেটের দিকনির্দেশনায় এগুলোর উপস্থিতি ও সেভাবে পরিকল্পনার বিষয়টি অনেক বেশি দাবি রেখেছিল।

যাহোক, বাস্তবতা হলো, এবার সত্যি অর্থে উচ্চ মূল্যের জ্বালানির পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি পরিবর্তন এনে- বিশেষ করে কঠিন সময় সংসার চালানোর মতো করেই একটি বাজেট করার নির্দেশ এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে।

সাংবাদিক হিসেবে অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর এই বাস্তব সিদ্ধান্ত অনেক সময় তাঁর দলীয় জনপ্রতিনিধিদের চাপে কিছুটা হলেও বদলে যায়। যেমন, নানান জনের ঘরের দুয়ারে গিয়ে গাড়ি থামানোর জন্যে এলজিআরডির মন্ত্রণালয় থেকে করা হয় অহেতুক বিশাল খরচ। যার থেকে আসলে ওইভাবে কোন রিটার্ন নেই। এই খরচ ধীরে ধীরে করা যায় কিনা, কারণ এই বিনিয়োগ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লাভ এক অর্থে নেই বা খুবই কম। এ নিয়ে বহুবার আলোচনা হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে। তিনি অনেক সময় বলতেন, প্রধানমন্ত্রীও এই অহেতুক খরচে বিরক্ত। সবাই কেবল এসে তাঁর কাছে অহেতুক পাকা রাস্তা করার জন্যে বলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবারও বলতেন, লোকাল জনপ্রতিনিধিরা ভোটের রাজনীতির কথা বলে শেষ পর্যন্ত এ কাজে সফল হন।

তবে এবার যেহেতু কঠোরতার বছর, তাই যতই নির্বাচনি বছর হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, ভোটের রাজনীতির জন্যে এবারের বাজেটে কোনও অহেতুক ব্যয় না করাই ভালো। ভারতের সাবেক ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, বর্ষীয়ান রাজনীতিক এল কে আদভানি তৃতীয় বিশ্বের ভোটের রাজনীতি যে উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে সেটা শতভাগ বিশ্বাস করেন না। আর উন্নয়নই যদি নির্বাচনে জয়লাভের সবটুকু হতো, তাহলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপিরই নিরঙ্কুশ জয়লাভের কথা ছিল। অপর দিকে বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো অবকাঠামোতে গত পনের বছর বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা সারা বিশ্বে শুধু নয়, দেশের মানুষের কাছেও প্রশংসিত। তাই আগামী নির্বাচনে নতুন করে লোকাল রাস্তাঘাট তৈরি করে অহেতুক অর্থ ব্যয় করলে যে ওইসব এলাকার জনপ্রতিনিধির নির্বাচনি বিজয় নিশ্চিত হবে এমনটি ভাবার কোনও সুযোগ নেই। কারণ, এ সত্য এখন সরকারি দলের অধিকাংশকে মানতে হবে, তাদের নির্বাচনে বিজয়ী হতে হবে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে।

এমনকি তাদের অনেকের কাজ মূলত শেখ হাসিনার উন্নয়নের জনপ্রিয়তা অনেকখানি বাধাগ্রস্ত করছে। সবাই জানেন, সাধারণ মানুষ ইঁদুরের মতো। তারা বিড়ালকে দেখেই সিংহ মনে করে। তাই বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাই সাধারণ মানুষের কাছে ওই ‘বিড়াল সিংহ’। এরা কিন্তু অতি ক্ষুদ্র কারণে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে ধ্বংস করছেন। কারণটি ক্ষুদ্র হলেও অনেক বড়। বাস্তবে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে এটা প্রথম উল্লেখ করেন প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমদ ১৯৯৪ সালের দিকে। তিনি বলেন, এ দেশে আইয়ুব খানের আমলেও যা ঘটেনি, বিএনপির স্থানীয় নেতারা সেই কাজ করছে। তিনি বলেন, এ দেশে একটা নিয়ম ছিল, খেয়াঘাটের ডাক, পুলের টোল, বাজারের ইজারা, বাসস্ট্যান্ড এগুলো সরকারি প্রশাসনে নিয়ম মাফিক টেন্ডার হতো। এখানে কোনও চাঁদাবাজি বা সরকারি রাজনৈতিক দলের নেতারা হস্তক্ষেপ করতো না। এখন বিএনপির স্থানীয় নেতারা ও একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি প্রশাসনকে বাধ্য করছে, এগুলো তাদের নিজের নামে দিতে, না হয় তাদের পছন্দের লোককে দিতে। আর এর মাধ্যমে চলছে চাঁদাবাজি। যা এলাকার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ১৯৯৬-এর প্রকৃত নির্বাচনে বিএনপিকে তাদের এ কাজের মাশুল দিতে হয়েছিল। বর্তমানে এ কাজটি দেশের বেশিভাগ জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের জনপ্রতিনিধিরা করছে। আর এর ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তারা প্রতি মুহূর্তে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই নির্বাচনের জন্যে আগামী বাজেটে বাড়তি অহেতুক উন্নয়নের থেকে মূলত এদের থামানো দরকার অনেক বেশি।

আর দেশের ও বর্তমান বিশ্বের এই পরিবর্তিত সময়ে নির্বাচনের পাশাপাশি অবশ্যই বাজেটে গুরুত্ব রাখে আগামী অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। পরিবর্তিত এই বিশ্বে সব থেকে বড় বিষয়টি সামনে আসছে -পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যাওয়া। ইউরোপ ও আমেরিকার এই অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যাবার ফলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সস্তা শ্রমনির্ভর উৎপাদিত পণ্য ও জনশক্তি রফতানির বাজার সংকুচিত হবে। এশিয়ায় চায়নাসহ যে দেশগুলোর অর্থনীতি নতুন গতিতে এগিয়ে চলছে তারাও অন্তত আগামী বিশ থেকে তিরিশ বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং সস্তা শ্রমনির্ভর পণ্য রফতানিকারক দেশ থাকবে। তারা খুব বেশি অন্যের বাজার হবে না। তাই এশিয়াতে বিকল্প বাজার তৈরি করা বেশ কষ্টের। চায়নায় আমাদের ওইভাবে উল্লেখ যোগ্য কোনও রফতানি নেই। ভারতে দুই বিলিয়ন ডলারের মতো রফতানি হয়, তাও বিভিন্ন সময়ে তাদের নানান বাধার মুখে পড়তে হয়। কারণ, তারাও মূলত সস্তা শ্রমে একটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী দেশ। তাছাড়া তাদের জনসংখ্যাও বাড়ছে, তরুণের সংখ্যা বাড়ছে- তাই সেখানে বাংলাদেশের পণ্যের বড় বাজার আশা করা ভুল হবে। অন্যদিকে চায়না যত বড়ই অর্থনীতি হোক না কেন, তার অঢেল জনশক্তি। সেখানে জনশক্তি রফতানির কোনও সুযোগ আশা করা যায় না।

এ কারণে এ মুহূর্তে দেশ যেমন জ্বালানি তেলের সংকটে নানান দিক থেকে ধাক্কা খাচ্ছে, ভবিষ্যতে এই শ্রম নির্ভর পণ্য রফতানি ও সরাসরি শ্রম রফতানির ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে একই রকম ধাক্কা আসতে পারে। যে কারণে, এই বাজেট থেকেই ভবিষ্যতের অর্থনীতির নতুন রূপরেখার সূচনা করা প্রয়োজন। যার মূল হবে বহুমুখী পণ্য, অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী বাজার ও দেশের জনশক্তির জন্যে দেশে কর্মসংস্থান।

পরিশেষে বলা যায়, এবারের বাজেট মূলত উচ্চ জ্বালানি মূল্যের পৃথিবীতে নিজেকে রক্ষা করা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে মাথায় রেখে নিজস্ব অর্থনীতি প্রণয়নের দিকনির্দেশনারই দাবি রাখে।

লেখক: স্বদেশ রায়

সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত।