তালপাতার পাখায় সংসারে সুবাতাস

বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যানের বাতাসের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং বিদ্যুৎ চলে গেলেই খোঁজ পড়ে এই তালপাতার পাখার। রঙিন কাপড়ে চারপাশ মুড়ে, সূচিকর্ম করা এই পাখাগুলো গ্রামীণ ঐতিহ্যের কথা বলে। গ্রামীণ সমাজের গল্প বলে। এই পাখা তৈরি আর বিক্রি করে এখনো চলে অনেক মানুষের সংসার। নওগাঁর ভালাইন গ্রামও সে রকমই এক গ্রাম।

মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের ছোট এক গ্রাম ভালাইন। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই গ্রামের নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরি করছেন। কালের পরিক্রমায় এটি অনেকেরই পেশা হয়ে গেছে। আর ভালাইন গ্রামকেও লোকজন এখন ‘পাখা গ্রাম’ বলেই চেনে।

গ্রীষ্মকালে বিশেষ করে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আশ্বিন, কার্তিক, চৈত্রসহ কয়েকটি মাসে প্রচণ্ড দাবদাহ এবং ভাপসা গরম পড়ে। এ সময় তালপাতার পাখার চাহিদা বেড়ে যায়। তাই এ সময় ভালাইন গ্রামের ঘরে ঘরে দেখা যায় পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী-পুরুষ।

তালপাখা তৈরি করে অনেকের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। পুরুষরা পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভেজানোর পর পরিষ্কার করে পাখার আকৃতি দেন। এরপর রংমিশ্রিত বাঁশের কাঠি, সুই ও সুতা দিয়ে পাখা বাঁধার কাজটা করেন গ্রামের গৃহবধূরা। অনেকে পাখার ওপর ফুল-পাতার নকশা করে এগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলেন। একজন নারী প্রতিদিন ৮০-১০০ পিস পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারেন। ১০০টি হাতপাখা তৈরি করলে ৭০ টাকা পান তারা। বর্তমানে গ্রামের প্রায় ৭৫টি পরিবারের শতাধিক নারী তালপাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তবে কাজের তুলনায় মজুরি খুবই কম বলে জানান এসব গ্রামীণ নারী কারিগর।

অন্যদিকে পাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিভিন্ন এনজিওর (বেসরকারি সংস্থা) থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে গিয়ে লাভের একটি অংশ চলে যায় সেখানে। স্বল্প সুদে ঋণ ও সরকারি সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তারা।

গৃহবধূ আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে পাখা তৈরির কাজ করছি। আমাদের সন্তানরাও এখন

পড়াশোনার পাশাপাশি পাখা তৈরি করতে সহযোগিতা করছে। তবে পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি খুবই কম। ১০০ পিস পাখার কাজে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বিনিময়ে মূল্য পাওয়া যায় মাত্র ৭০ থেকে ৮০ টাকা। পারিশ্রমিক একটু বেশি হলে পরিবারে একটু বাড়তি আয় হতো।’

কথা হয় তালপাখা ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব তালপাখা চলে যায় রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রংপুরসহ কয়েকটি জেলায়। তবে পাখা তৈরিতে যে পরিশ্রম ও খরচ হয়, সে তুলনায় দাম কম জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘তালপাতা, বাঁশের কাঠি, সুতা, মোম, রং, কারিগরের খরচসহ প্রতি পিস পাখায় খরচ পড়ে ৮-৯ টাকা। এসব পাখা পাইকারি ব্যবসায়ীরা ১০-১২ টাকা পিস হিসেবে কিনে নেন। খুবই সীমিত লাভ আমাদের। প্রতিবছর প্রায় আমাদের এখান থেকে ৪-৫ লাখ তালপাখা দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়ে থাকে। সরকারিভাবে যদি একটু সহযোগিতা করা হতো, তবে আমরা কাজগুলো আরও বৃহৎ পরিসরে করতে পারতাম।’

আরেকজন তালপাখা ব্যবসায়ী শহীদ হোসেন বলেন, ‘এ ব্যবসায় ৮-১০ বছর হয়ে গেল। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিসিক কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি এই কুটির শিল্পের উন্নয়নে আমাদের সহযোগিতা করতে।’

স্থানীয় উত্তরগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হাসান মণ্ডল বলেন, ‘সহজ শর্তে ঋণসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হলে এই ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের আরও প্রসার ঘটবে বলে মনে করি।’

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন নওগাঁর উপব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হবে।