প্রযুক্তির কল্যাণে কমেছে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি

খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামে বাস করেন সোবহান আলী সানা। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তিনি হারিয়েছেন আপন দুই ভাইকে। ২০০৭ সালে আরেক শক্তিশালী ঝড় কেড়ে নিয়েছে তার বসতবাড়ি। ৬৫ বছর বয়সী মানুষটি অন্তত ৩০টি উচ্চ গতিবেগের ঝড়ের তাণ্ডবের সাক্ষী হয়েছেন।

সোবহান আলী সানা বলেন, ‘এক সময়ে ঝড়ের পর আমাদের গ্রামে লাশের সারি পড়ে যেত। কত মানুষ বানের (পানি) টানে ভেসে যেত তার হিসাব আমরা রাখতে পারতাম না। এখনও সেই রকম বড় বড় ঝড় হয়। তবে আগের মত শত শত মানুষ মারা যায় না।’

সোবহান আলী সানা যে গ্রামটিতে বসবাস করেন সেটি সুন্দরবন সংলগ্ন শিবসা ও সুতারখালী নদীর মোহনায় অবস্থিত। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রায় প্রতি বছরই সেখানে আঘাত হানে একাধিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস।

সানা বলেন, ‘আগে ঝড় হলে আমরা ঠিক পেতাম নদীর পানি বাড়লে বা আকাশে মেঘের পরিমাণ বাড়লে। কত গতিতে ঝড় আসছে, কতটা ক্ষতি করবে এটা বুঝতে পারতাম না। এখন ঝড়ের অন্তত ১০ দিন আগে থেকে এলাকার মানুষকে সতর্ক করা হয়। বাড়ি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ডেকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ১৯৮৮ সালের ঝড়ের দিনও যদি আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারতাম, তবে আপন দুই ভাইকে হারানো লাগতো না।’

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেশের উপকূলে আঘাত হানা ৯টি ঘূর্ণিঝড়কে মেজর (বড়) তালিকায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর আঘাত হানা ঝড়ে প্রাণহানি ঘটে ৩ লাখ মানুষের। ওই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। আর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৬ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত।

একই গতিবেগের ঝড় উপকূলে আবারও আঘাত হানে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। তাতে প্রাণহানি হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জনের। তবে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর একই গতিবেগের ঝড় আঘাত হানলেও প্রাণহানি হয়েছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৬৩ জনের।

২০০৭ সালে আঘাত হানা সিডর নামের সুপার সাইক্লোনে বসতবইড় হারানো অনেকের মধ্যে একজন ফজলু মোড়ল।

ঝড়ের দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই আমাদের এখানে ছোট-বড় ঝড় আসে। এটা আমাদের সয়ে গেছে। তাই ঝড়ের সময়ে বাড়ি ছেড়ে যেতে সবার অনীহা থাকে। সিডর হয়েছিল রাতের বেলা। আগের দিন এলাকায় বার বার মাইকিং করা হচ্ছিল। লাল পতাকা টানানো হয়েছিল।

‘আমাদের বাড়ির নারী ও শিশুরা সবাই আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গিয়েছিল। আমি যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। একদল স্বেচ্ছাসেক এসে বিকেলে আমাকে জোর করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। রাতে যখন মাথার উপর দিয়ে ঝড় চলে যায়, তখন আমি বুঝতে পারিনি, বাইরে কতটা বিপজ্জনক ঝড় হচ্ছে।’

ঝড় শেষে কালাবগি গ্রামের বাড়িতে সবার আগে ফিরেছিলেন ফজলু মোড়ল। তিনি বলেন, ‘এসে দেখলাম ঘর চলে গেছে নদীর পানিতে। একটি গামছাও কোথাও খুঁজে পেলাম না। এক রাতে সব সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেল। পরে ছেলে মো. নাছের মোড়ল এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ঘর কোথায় গেছে? তখন নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।’

ফজলু মোড়ল বলেন, ‘ঘর নদীর পানিতে চলে গেছে- এই কষ্ট তখন মনে ছিল না। ভাবছিলাম, রাতে যদি আশ্রয় কেন্দ্রে না যেতাম তবে ছেলের মুখ আর দেখতে পারতাম না। আমিও পানিতে ভেসে যেতাম।’

ফজলু মোড়লের পরিবার এখন বসবাস করে শিবসা নদীর তীরে পরের জমি ইজারা নিয়ে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ছোট একটি গোলপাতার ঘরে থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন সুন্দরবনের ওপর ভরসা করে। সিডরে সম্পদ হারিয়ে তার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

মোখার ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী পরিচালিত জায়ান্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের তথ্যমতে, বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদে এটি ২২১ কিলোমিটার গতিবেগে ১৪ মে আঘাত হানতে পারে। আর মোখার প্রভাবে ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।

মোখার ক্ষতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর প্রশাসন। খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় খুলনায় ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শুএনা খাবার, পানি, শিশুখাদ্য ও ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গবাদি পশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি উদ্ধারকারী দল।

‘নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তায় কাজ করবেন। উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতে কাজ চলছে। জেলার ৯৫ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। সে সঙ্গে মানুষের চিকিৎসাসেবায় ১১৬টি মেডিক্যাল টিম, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রয়েছে।’

অন্যদিকে সাতক্ষীরাতে ৮৮৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে রাখার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘সাতক্ষীরা একটি দুর্যোগপ্রবণ জেলা। যে কোনো দুর্যোগ এলেই সাতক্ষীরা উপকূলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

‘ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও পাকা স্থাপনা স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে উপকূলীয় নদীতে নৌকা ও ট্রলার প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি মোকাবিলায় জেলার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক আজিজুর রহমানের বলেন, ‘জেলার ৯টি উপজেলায় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭৫ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ৪৪৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

‘এছাড়া জেলা সদরসহ প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ৯ উপজেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৯টি মেডিক্যাল টিম। রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কয়েক শ’ স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’