করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই সোয়া বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও কিছুটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংকট সামাল দিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিপিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে ধরনা দিচ্ছে সরকার; সেই সঙ্গে কৃচ্ছ্রসাধনের পথও বেছে নিয়েছে। সে কারণে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে; চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মূল এডিপির মাত্র ৪০ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংকট-চাপ যতই থাকুক না কেন, নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। আগামী বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় বিশাল আকারের এই এডিপি অনুমোদন দেয়া হবে। নতুন এডিপি হবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি এবং মূল এডিপির তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দিয়েছিল। পরে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে এবং খরচ কমাতে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অগ্রাধিকার ও আমদানিনির্ভর প্রকল্পের গতি কমিয়ে দেয়া হয়। এতে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত গত মার্চে এডিপি সংশোধন করে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই বছরের শেষ অথবা আগামী বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে ভোটের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। আগামী ৮ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন বাজেট। সে হিসাবে আগামী বাজেটের ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) বাস্তবায়ন করবে বর্তমান সরকার। আর নতুন সরকার বাস্তবায়ন করবে বাকি ছয় মাস জানুয়ারি থেকে জুন।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ডলারের সংকট এখনো কাটেনি।
এমন সংকটকালেই টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। মূলত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পরিকল্পনা সাজাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
পরিকল্পনা কমিশন নতুন এডিপির যে খসড়া চূড়ান্ত করেছে তাতে নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের প্রায় ২৯ শতাংশ রাখা হয়েছে। একক খাতে বরাদ্দের বেলায় কয়েক বছর ধরেই এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা। এবার তা আরও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এডিপিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৬৪ শতাংশ এবং প্রকল্প সহায়তা হিসেবে বিদেশি অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের প্রায় ৩৬ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দিয়েছিল। পরে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অগ্রাধিকার ও আমদানিনির্ভর প্রকল্পের গতি কমিয়ে দেয়া হয়। এতে এডিপি বাস্তবায়নে কিছুটা ধীরগতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত গত মার্চে এডিপি সংশোধন করে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। গত মার্চ পর্যন্ত (জুলাই-মার্চ) সেই সংশোধিত এডিপির ৪১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, অর্থাৎ ৯৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সংশোধিত এডিপির চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে খসড়া প্রস্তুত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিভাগ। এদিকে আগামী অর্থবছরে জন্য স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে ১১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রস্তাবিত এ বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।
খসড়া এডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৪ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যা মোট বরাদ্দের প্রায় ১৭ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে শিক্ষা খাতে। চতুর্থ সর্বোচ্চ ২৭ হাজার ৪৫ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধা খাতের জন্য।
এরপর রয়েছে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতের জন্য ১৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতের জন্য ১৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ। কৃষি খাতে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বা ৪ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে দেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা বা ২ শতাংশ এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা।
এ ছাড়া জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষার জন্য ৩ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা, সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিনোদন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, সাধারণ সরকারি সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১১ কোটি টাকা।
প্রতিবছরই অর্থবছরের প্রথম ভাগে এডিপি বাস্তবায়নের হার কম থাকে, দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাড়তে থাকে। কিন্তু এবার ৯ মাস পার হয়ে গেলেও সরকারের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের গতি নেই। অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে অর্থাৎ সাত মাসে ২৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল; আট মাসে খরচ হয়েছিল সংশোধিত এডিপির ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ। জুলাই-মার্চ অর্থাৎ ৯ মাসে ব্যয় হয়েছে ৪১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ৯ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের এই হার গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘নতুন এডিপিতে প্রতিবারের মতো এবারও যোগাযোগ অবকাঠামো ও কৃষিকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অংশ হিসেবেই এটা করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখনো কৃষি খাতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান। আবার সহজ যোগাযোগব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সেই কৃষিপণ্যই পাবে তুলনামূলক বেশি মূল্য। কৃষকের হাতে যাবে বেশি টাকা। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হওয়ার মাধ্যমেই চাঙা হবে জাতীয় অর্থনীতি। এই সংকটকালে কৃষি খাত আমাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়ে আসছে।’