ডেল্টা সুশীল সমাচার

ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় নেই, ভবিষ্যতে আবার দেখা হবে এমন সম্ভাবনাও নেই আর দেখা হলে পরস্পরকে চিনতে পারবো তেমনটাও সম্ভবত সম্ভব না। লেখার শুরুতেই এমন একজন অপরিচিত ব্যক্তির প্রসঙ্গটা টেনে আনার কারণ তিনি এমন একটি চরিত্রের অধিকারী মানুষ যাদের নিয়েই আজকের লেখাটি বিস্তৃত করবো।

এই মানুষগুলো দেশকে গাল দিয়ে আর দেশের গর্বের জায়গাগুলোতে অসন্মানিত করে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পান এবং বিশ্বাস করেন যে এমন আচরণ তাদের গ্লোরিফাই করে। ভদ্রলোকের সাথে আমার প্রথম এবং একমাত্র সাক্ষাৎটি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি লাউঞ্জে। একটা সময় ছিল যখন দেশের বিমানবন্দরগুলোতে লাউঞ্জ বলতে শুধু ভিআইপি লাউঞ্জ থাকতো। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন এবং উধ্র্বতন কর্মকর্তারা শুধু সেই লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ পেতেন।

সামনে যখন আরেকটি নির্বাচন অত্যাসন্ন, আর আবারো যখন মাঠে নেমেছে সুশীল নামধারী এই বাংলাদেশী বিদ্বেষীরা তখন আমাদের এই জাজমেন্টের জায়গাগুলোতে আরেকটু জাজমেন্টাল হতে হবে। একবার পা পিছলে আমরা ওয়ান ইলেভেনে গাড্ডায় গিয়ে পড়েছিলাম। পরে অনেক কষ্টে উঠে এসেছি, তবে তার জন্য খেসারত মোটেও কম দিতে হয় নি। আবার যাতে পাটা না পিছলায় সে ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক থাকাটা অত্যান্ত জরুরি।

সেসব জায়গা ছিল আমজনতার ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। ঊধ্র্বতন সরকারী কর্মকর্তার ছেলে হওয়ার সুবাদে বাবার কল্যাণে ভিআইপি লাউঞ্জ নামক এই বিশেষ সেবা গ্রহণের সুযোগ আমার সুখস্মৃতিতে এখনও জাজ্জ্বল্যমান। তবে এখন জমানা পাল্টে গেছে। এখন পকেটে একটা মোটামুটি ভারি ক্রেডিট কার্ড থাকলেই দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে যে একাধিক লাউঞ্জ আছে সেসবের পরিসেবা গ্রহণ করা যায়। এখন আর এই বিশেষ সুবিধা ভোগ করার জন্য নামের শেষে ভিআইপি তকমাটি থাকার প্রয়োজন পড়ে না।

প্রথমে ভদ্রলোককে খেয়াল করিনি। খেয়াল করলাম তার বাগাড়ম্বরের কারণে। শুক্রবার রাতে সিলেট-ঢাকা রুটে বিমানের শেষ ফ্লাইটটি যথারীতি অন শিডিউল। লাউঞ্জের রিসেপশনে বসা ভদ্রলোক বিনীতিভাবে তার বিশিষ্ট ক্লায়েন্টদের অনুরোধ জানাচ্ছেন বিমানে আসন নেয়ার জন্য। শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন ভদ্রলোক। কথায় বুঝলাম তিনি দেশে থাকেন না। বিমানের শিডিউল মেইন্টেইন করাটা তার কাছে ‘মিরাকেল’।

রিসেপশনিষ্টকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, বিমান যদি অন টাইমই ছাড়বে তবে তার এত খরচ করে গিয়ে লাউঞ্জে বসার প্রয়োজন কি ছিল? একটু পরে বিমানে চড়ার সময় দেখলাম ভদ্রলোক বিমানের আধুনিক ড্যাশ-৮ বিমানটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। শুরুতে রাগে পিত্তিটা জ্বলে গেলেও, অগত্যা বুঝতে পারলাম তিনি ‘ক্যাটাগরি-১ বাংলাদেশ’ বিদ্বেষী। এই ক্যাটাগরির লোকেরা দেশের সুনামের জন্য হানিকর, তবে দেশের জন্য অতটা নন। তারা আমার ধারণা হয় বিকৃত রুচির অধিকারী অথবা মানসিক রোগে আক্রান্ত।

তবে আরেক ধরনের মানুষ আছেন যারা ‘ক্যাটাগরি-২ বাংলাদেশ বিদ্বেষী’। এরা সুশীল সেজে আমাদের আশপাশে ঘুরঘুর করেন, সুন্দর-সুন্দর কথা বলে টকশোগুলোতে মধ্যমনির আসন ধরে রাখেন আর সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, এরা অল্পকিছু পয়সায় বিক্রি হন আর তাদের পাশ্চাত্যের প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটান। এরা অবশ্যই দেশের জন্য ক্ষতিকর। নানা সময়ে দেশের বড় বড় ক্ষতি এদের দ্বারা হয়েছে। সর্বশেষ ওয়ান ইলিভেনে আমরা এদের দৌড়াদৌড়ি দেখেছি। হালে এরা আবার দৌড়াতে শুরু করেছেন। লক্ষ্য একটাই – আগামী নির্বাচনে গণতন্ত্রিক শক্তিকে উৎখাত করে যদি তাদের প্রভুদের বংশদবদ কোনো সরকারকে তখতে বসানো যায়।

তবে এদের মধ্যে একটি সাবক্যাটাগরি আছে যারা আরো অনেক বেশি ক্ষতিকর, আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় যাকে বলে অনেক বেশি ভিরুলেন্ট। কোভিড-১৯-এর ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আর অমিক্রনের মধ্যে যেমন ফারাক, এই দুই সাব-ক্যাটাগরির বাংলাদেশের মানুষগুলোর মধ্যেও পার্থক্যটাও তেমনই। এরাও সুশীলের দেশে ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করেন আর সুযোগ পেলেই ছোবলটা দেন। এদের ছোবলে বিষটাও অনেক বেশি ঝাঁঝালো। কদিন আগে এমনি একজন বিষাক্ত সুশীলের মুখোশটা উন্মোচন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এই সুশীল দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের প্রধান। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনি গণহত্যা নিয়ে কোর্স পরিচালনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণহত্যা বিষয়ে জ্ঞান দান করেন এবং পাশাপাশি আগ্রহী বিদেশীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তরের গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখান এবং অবশ্যই সেসময় গণহত্যা বিষয়ক তার নিজস্ব মতবাদ প্রচার করেন।

এই সুশীল কদিন আগে একটি বই লিখেছেন, তার ভাষায় যা আমাদের গণহত্যার উপর এ যাবৎকালের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ও কার্যকর দলিল। আমি নিজের কানে এ নিয়ে তাকে একটি বিদেশী দূতাবাসের অনুষ্ঠানে বসে বাগাড়ম্বর করতে শুনেছি। সবচেয়ে তাজ্জবের ব্যাপার তার মুখেই শোনা, তার এই বইটি নাকি আমাদের মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী সদস্যের আনুকূল্যে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি বিচারপতি মানিক তার দীর্ঘ একটি কলামে এই সোকল্ড সুশীল অধ্যাপক রচিত বইটির ব্যবচ্ছেদ করেছেন। এর পরপরই স্বোচ্চার হয়েছেন অনেকেই। তার অপসারণ ও বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সংগঠন। বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও।

বহুল আলোচিত-সমালোচিত বইটিতে এই অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করেছেন বিহারী হত্যাকাণ্ডের জন্য। প্রশ্ন তুলেছেন শহীদদের সংখ্যা নিয়েও। আর তার বাড় এতই বেড়েছে যে, তিনি এমনকি এও বলেছেন যে ৭ মার্চের ভাষণ নাকি বঙ্গবন্ধু শেষ করেছিলেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। এই জয় পাকিস্তান তত্ত্বটি এর আগেও আমরা একজন বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাকে কপচাতে শুনেছিলাম। পরে অবশ্য জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি তার এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচারের জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন। বেশ ক’বছরের বিরতিতে আবার সেই তত্ত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছেন এই সুশীল। সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আরেকটি প্রয়াস আরকি।

এমনি আরো কিছু ‘ডেল্টা সুশীলের, তৎপরতা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় উঠে আসছে। ভারতের বহুল প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজারের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে কোলকাতায় অবস্থিত একটি পাশ্চাত্য দূতাবাসকে কেন্দ্র করে ওয়ান ইলেভেনের আরেক কুশীলব আর এদেশের জামায়াতীদের লম্ফ-ঝম্প এখন আমাদের মিডিয়া আর আড্ডাগুলোয় হট টপিক। মহান স্বাধীনতা দিবসে ‘ফুল তত্ত্ব’ দিয়ে চুয়াত্তরের ‘জাল তত্ত্বের’ পুনঃমঞ্চায়নের আরেকটি ব্যর্থ প্রয়াস ক’দিন আগে আদালতের বারান্দা পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

বাাংলাদেশ বিদ্বেষীদের এই ক্যাটাগরি আর সাবক্যাটাগরিগুলো নিয়ে আলোচনার একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। আমার একটা পর্যবেক্ষণ আমরা মাঝে-সাঝেই এই বিভিন্ন ক্যাটাগরির বাংলাদেশ বিদ্বেষীদের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলি। কোন ক্যাটাগরিকে ধরতে হবে আর কোনটাকে মারতে হবে এ নিয়ে আমাদের জাজমেন্ট প্রায়শঃই ভুলভাল হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় আমরা বড় মাছকে জালে আটকেও ছেড়ে দেই আর কখনো কখনো ছোট মাছ শিকার করে মড় মাছ ভেবে জাবর কাটতে থাকি।

সামনে যখন আরেকটি নির্বাচন অত্যাসন্ন, আর আবারো যখন মাঠে নেমেছে সুশীল নামধারী এই বাংলাদেশী বিদ্বেষীরা তখন আমাদের এই জাজমেন্টের জায়গাগুলোতে আরেকটু জাজমেন্টাল হতে হবে। একবার পা পিছলে আমরা ওয়ান ইলেভেনে গাড্ডায় গিয়ে পড়েছিলাম। পরে অনেক কষ্টে উঠে এসেছি, তবে তার জন্য খেসারত মোটেও কম দিতে হয় নি। আবার যাতে পাটা না পিছলায় সে ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক থাকাটা অত্যান্ত জরুরি।

লেখক: ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল,
ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।