সাড়ে ৯ মাস পর পদ্মা সেতুতে ফের মোটরসাইকেল, সেতুতে পারাপারে মোটরসাইকেল আরোহীদের ভিড়। ছবি- ফোকাস বাংলা
রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, নগর গণপরিবহনে ঘরমুখী যাত্রীদের চাপ রয়েছে। সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, সদরঘাট, মহাখালী ও গাবতলীমুখী পরিবহনে ভিড় সবচেয়ে বেশি। এসব স্টেশন থেকে কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে, কেউ-বা লঞ্চে চেপে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন। কোথাও রাস্তা ফাঁকা থাকলেও সিগন্যালগুলোয় কিছুটা যানজট ছিল। তবে প্রতি বছরের মতো এবার ঘরে ফেরা মানুষের তেমন সমস্যা হয়নি। নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরছে মানুষ। সদরঘাট থেকেও ঠিক সময়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে লঞ্চ।
সাড়ে ৯ মাস পর পদ্মা সেতুতে ফের মোটরসাইকেল, সেতুতে পারাপারে মোটরসাইকেল আরোহীদের ভিড়। ছবি- ফোকাস বাংলা
গাবতলী বাস টার্মিনালে নেই যাত্রীর চাপ
গতকাল রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে ঘরমুখী মানুষের তেমন চাপ লক্ষ করা যায়নি। বাড়ি যাওয়ার জন্য ভোর থেকে বাসস্ট্যান্ডগুলোয় এসে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে যাত্রীদের। একেকটি বাস আসার সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা সেই সব বাসে চেপে বসেছে। যদিও সড়কের বিভিন্ন জায়গায় যানজটের কারণে কিছুটা সময় লাগছে বলে জানিয়েছেন পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর মানুষের চাপ কম।
গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড গরমে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বাস টার্মিনালে যাত্রীদের বিশ্রামাগারের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে অনেকেই টার্মিনালের বিভিন্ন জায়গায় অপেক্ষা করছেন কাউন্টারগুলোর সামনে। নির্ধারিত সময়ে কোনো কোনো বাস না ছাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে যাত্রীরা। প্রচণ্ড গরম সহ্য করেও শুধু বাড়ি যাওয়ার জন্য এসব কষ্ট সহ্য করছে ঘরমুখী এসব মানুষ।
বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু। ছবি- সংগৃহীত
হানিফ পরিবহনের ম্যানেজার আশরাফ বলেন, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারকে কেন্দ্র করে যে ধরনের যাত্রীর চাপ থাকে, ঈদকে কেন্দ্র করে সে ধরনের চাপ রয়েছে। তবে বিশেষ বা বাড়তি কোনো চাপ নেই। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় অনেকেই গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে না গিয়ে অন্যান্য বাস টার্মিনাল থেকে বাসে করে যাচ্ছে। যে কারণে বাস ও যাত্রীর চাপ কিছুটা কম রয়েছে। তবে গার্মেন্টস ছুটি হলে যাত্রীর চাপ কিছুটা বাড়বে বলে তিনি জানান।
বদলে গেছে রেলের ঈদযাত্রা
রেলের টিকিট কালোবাজারি একটি চিরাচরিত সমস্যায় পরিণত হয়েছিল। কালোবাজারি থেকে মুক্ত করতে এবার অনলাইনে শতভাগ টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রতি বছর ঈদে অগ্রিম টিকিট কেনার জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনে সেহরি খেয়ে এসে যাত্রীরা লাইন ধরত। এবার শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হওয়ায় এই চিত্র বদলে গেছে।
এর আগে ঈদের পাঁচ দিন আগে রেলের অগ্রিম টিকিট কাটা যেত, এবার সেটি বাড়িয়ে ১০ দিন করা হয়। এছাড়া ট্রেনের ছাদে বা বিনা টিকিটে ভ্রমণ ঠেকাতে এবার কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিনা টিকিটের যাত্রীদের স্টেশনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এসব কারণে এবার কমলাপুরসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনগুলোতে আগের মতো সেই চিরচেনা ভিড় নেই।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, রেলের ঈদযাত্রার চতুর্থ দিনেও বজায় রয়েছে শৃঙ্খলা। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে তিন দফা চেকিং শেষে যাত্রীদের প্ল্যাটফর্মে ঢোকানো হচ্ছে। কিছু ট্রেন দেরিতে ছাড়লেও যাত্রীরা একে শিডিউল মিস না বলে ‘স্বস্তির ঈদযাত্রা’ বলেই মন্তব্য করছে।
ট্রেনের স্টাফদের মন্তব্য, জীবনে বহু ঈদ দেখেছি। আগের ঈদগুলোতে যাত্রীদের জায়গা দিতে পারতাম না। এবারে ঈদে সেই চিত্র নেই। যাত্রী স্বাভাবিক সময়ের মতো। ফলে মানুষ প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে স্বস্তিতে বাড়ি যেতে পারছে।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভোগান্তি রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। ছাদে কিংবা বিনা টিকিটে ট্রেনযাত্রার কোনো সুযোগ নেই। স্টেশনে টিকিট ছাড়া কেউ প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছে না। টিকিট না থাকলে তাকে দাঁড়ানো টিকিট (স্ট্যান্ডিং টিকিট) কেটে স্টেশনে প্রবেশের অনুমতি নিতে হচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপত্তায় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে রয়েছেন র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরোয়ার জানান, ভোগান্তি রোধে কঠোর অবস্থানে তারা। ছাদে ওঠা কিংবা টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ সম্ভব নয়। তাই এবার ঈদে পুরো ট্রেনযাত্রাই হবে স্বস্তির।
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল
গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে পদ্মা সেতুর উত্তর প্রান্তে টোল আদায় কার্যক্রম ও মোটরসাইকেল চলাচল পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, শৃঙ্খলায় থাকলে, দায়িত্বশীল থাকলে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকবে। এ সময় পদ্মা সেতুর উত্তর প্রান্তে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন সেতুমন্ত্রী। পরে মোটরসাইকেল চলাচল পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সেতুসচিব মনজুর হোসেন, মুন্সীগঞ্জ পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল-মামুনসহ সেতু বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা।
এদিকে পদ্মা সেতুর অতিরিক্ত পরিচালক আমির হায়দার চৌধুরী জানিয়েছেন, গতকাল দুপুর ২টা? পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৪৯টি মোটরসাইকেল পারাপার হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে ৪ হাজার ৫১৬টি মোটরসাইকেল এবং জাজিরা প্রান্ত দিয়ে ৩৩৩টি মোটরসাইকেল সেতুতে প্রবেশ করেছে। এতে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো টোল আদায় হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘ সময় পর পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রশংসা করেছেন চালক ও আরোহীরা। তাদের কথা, এই দিনটির জন্যই তারা অপেক্ষায় ছিলেন। মোটরসাইকেল চালকেরা জানান, সরকার নতুন করে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি দিয়েছে, তাতেই তারা অনেক খুশি। সব নির্দেশনা মেনেই মোটরসাইকেল নিয়ে তারা পদ্মা পারি দিতে চান।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কাগদী গ্রামের আনোয়ার দেওয়ান ও লতিফ কাজী বলেন, তারা ট্রলারে পদ্মা নদী পারাপার হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতেন। কিন্তু আজ মোটরসাইকেল নিয়ে সেতু পেরিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। এতে অনেক আনন্দ লাগছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে ব্যবসা করা জিল্লুর বলেন, ‘জীবনের প্রথম মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা সেতু পার হলাম। প্রায় ১৩ মিনিটে সেতু পার হয়েছি। অনেক আনন্দ লাগছে। ঈদের যাত্রা দুর্ভোগমুক্ত করার জন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৬ জুন পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রথম দিনেই সেখানে ঢল নামে মোটরসাইকেলের। ঐ দিন রাতে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ২৭ জুন ভোর থেকে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে সেতু বিভাগ।
ঢাকার বাইরে গেছে ২৯ লাখ সিম
ঈদযাত্রার প্রথম দুই দিন ১৮ ও ১৯ এপ্রিল মোবাইল সিমের গ্রাহকদের ঢাকায় আসা-যাওয়ার বিবরণ জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ দুই দিনে ঢাকা থেকে বাইরে গেছেন ২৯ লাখ ৯২৩ সিম ব্যবহারকারী। আর ঢাকায় এসেছেন ১৩ লাখ ৩০৫ জন।
যানজটমুক্ত সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক
ঈদযাত্রা শুরু হলেও চাপ নেই বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কসহ সিরাজগঞ্জের সব রুটে। ফলে দুর্ভোগমুক্ত উত্তরাঞ্চলের মানুষের ঈদযাত্রা। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী লেনে যানবাহনের কিছুটা চাপ থাকলেও কোনো ধরনের যানজট বা ধীরগতির খবর পাওয়া যায়নি। দুপুর থেকে ধীরে ধীরে যান চলাচলের চাপ কমেছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন ইয়াজদানী বলেন, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত গাড়ির চাপ ছিল| বেলা বাড়তেই গাড়ির চাপ কমতে থাকে। তবে বিকালের দিকে চাপ বাড়তেও পারে।
হাইওয়ে পুলিশের (বগুড়া অঞ্চল) পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। মঙ্গলবার থেকে ঈদযাত্রা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো যানজট, দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের সৃষ্টি হয়নি। আশা করছি পুরো ঈদযাত্রা স্বাভাবিক থাকবে।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আছে গাড়ির চাপ, নেই যানজট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেড়েছে গাড়ির চাপ, তবে নেই চিরচেনা সেই যানজট। এতে স্বস্তিতে রয়েছে যাত্রীরা। এত দিন মহাসড়কের সংস্কারকাজের কারণে মাঝেমধ্যে যানজটের সৃষ্টি হতো। ঈদ উপলক্ষে সংস্কারকাজ বন্ধ রেখেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে হাইওয়ে পুলিশ। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বলেন, মহাসড়কের সংস্কারকাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর কাজ পুনরায় শুরু হবে। মহাসড়কে যানজট এড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চাপ নেই দৌলতদিয়া ঘাটেও
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথ। কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই বদলে গেছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটের দৃশ্যপট। ব্যস্ততম সেই ঘাটে এখন নেই কোনো যানজট। কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই ঘরমুখী মানুষ সরাসরি ফেরি পার হয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে।
দৌলতদিয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জে এম সিরাজুল কবির বলেন, ঈদে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নদীতে নৌ-পুলিশের টহল রয়েছে।