দারিদ্র্য কমেছে

২৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ

কোভিড ও যুদ্ধের কারণে বর্তমান বৈশ্বিক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও দারিদ্র্যের হার অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। এ হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ গত ৬ বছরে দারিদ্র্য কমেছে ৫.৬ শতাংশ। আর চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে ৫.৬ শতাংশে নেমেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দারিদ্র্য হ্রাসের ফলে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত খুশি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

দারিদ্র্যের হার নির্ধারণে ‘খানাপ্রতি আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২’ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বুধবার বিবিএস মিলনায়তনে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমসহ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। গত ৬ বছরে পরিবার প্রতি আয় দ্বিগুণ হয়েছে এবং শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে অনেক। অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকেও উন্নতি ঘটেছে। তবে এ সময় বৈষম্যও কিছুটা বেড়েছে।

এইচআইইএস-নামের এ জরিপে দেখা যায়, দারিদ্র্যের হার শহরে ২০. ৫ শতাংশ আর গ্রামে এ হার ১৪.৭ শতাংশ। চরম বা অতি দারিদ্র্য ২০১৬ সালে ছিল ১২. ৯ শতাংশ। যা ২০২২ এই সময়ে ৭.৪ শতাংশ কমে হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। গ্রামে চরম দারিদ্র্য ৬.৫ শতাংশ আর শহরে ৩.৮ শতাংশ। এরও আগে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১.৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পথেই রয়েছে বাংলাদেশ। বিবিএস বলছে, গত ছয় বছরে খানা বা পরিবার প্রতি মানুষের আয়ও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬ সালে এ আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা।

যা ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। একই সময়ে মানুষের ব্যয়ও বেড়েছে। ২০২২ সালে মাসিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। জরিপে দেখা যায়, স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়ে ৭৪ শতাংশ হয়েছে। যা ২০১৬ সালে ৬৫.৬ শতাংশ ছিল। শহরে শিক্ষার হার ৮২ আর গ্রামে ৭০ শতাংশ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে জরিপে। ৯৯.৩৪ শতাংশ গৃহে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। যা ২০১৬ সালে ছিল ৭৫.৯২ শতাংশ। আর ২০২০ সালে ছিল ৫৫.২৬ শতাংশ।

এদিকে নিরাপদ পানির আওতায় এসেছে ৯৬ শতাংশ মানুষ। উন্নত টিউবওয়েল থেকে ৭৬.৮১ শতাংশ মানুষ পানি পান করে। আর ১৯.৩৪ শতাংশ মানুষ সরাবরাহ পানি পাচ্ছেন। উন্নত টয়লেট ব্যবহার করছে ৯২ শতাংশ মানুষ।

এদিকে মাসিক খাদ্য ব্যয় ১৪ হাজার টাকা হয়েছে। যা আগে ৭ হাজার ৩৫৪ টাকা ছিল। মাথাপিছু মাসিক আয়ও ৩ হাজার ৯৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৭ হাজার ৬১৪ টাকা হয়েছে। তবে মোট ব্যয়ের মধ্যে মানুষের খাদ্য সংক্রান্ত ব্যয় ৪৫.৮ শতাংশ। আগে এটা ছিল ৪৭.৭ শতাংশ। দেশ উন্নতির দিকে গেলে মানুষ খাদ্য ব্যয় কমে অন্য ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষের খাদ্য ব্যয় কমছে।

খাদ্য গ্রহণে ভিন্নতা এসেছে। আগে দিনে মানুষ ৩৬৭ গ্রাম ভাত খেলেও এখন তা কমে ৩২৮ গ্রামে নেমেছে। আর ২০১০ সালে মানুষ ৪১৬ গ্রাম ভাত খেত। তবে সবজি গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। আর মানুষ মাছ-মাংসও আগের চেয়ে বেশি খাচ্ছে। সব মিলিয়ে দৈনিক ২ হাজার ৩৯৩ কিলোক্যালরি গ্রহণ করছে। যা ২০১৬ সালে ছিল ২২১০ কিলোক্যালরি।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, দারিদ্র্য ২৪ থেকে ১৮ শতাংশে নামা একটি বিশাল অর্জন। বিশেষ করে এমন কোভিড আর যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও এমন অর্জন বড় আনন্দের বিষয়। করোনার সময় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত আর ১০০ কোটি ডলারের বিভিন্ন প্যাকেজ এটা অর্জনে সহায়তা করেছে। আমরা উৎপাদন এবং চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করিনি। আর মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় মানুষকে সুলভ মূল্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। রমজানেও ১ কোটি পরিবার সহায়তা পেয়েছে। নয়তো মূল্যস্ফীতি ১২/১৩ হয়ে যেত বলে মনে করছেন তিনি।

তবে বৈষম্য বৃদ্ধিকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। বৈষম্য হ্রাস আর দারিদ্র্য দূরীকরণকে প্রধান সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন তিনি। বৈষম্য রোধে উন্নয়নের নামে বালুমহল, মাছ মহল, পানি মহল ইজারা দেওয়া বন্ধ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী বলেন, গ্রামে এত বেশি সহায়তা যায়নি। এখন কাবিখা, খাদ্য সহায়তা, চাল দেওয়াসহ নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফলে দারিদ্র্য কমেছে। এখন ঘরে ঘরে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। এমনকি গ্রামে শ্রমিক সংকট দেখা দিচ্ছে। তবে বৈষম্য খুব বেশি বাড়েনি বলে মনে করেন তিনি। বরং গত ১৪ বছর বৈষম্য স্থির আছে জানান প্রতিমন্ত্রী।
মুক্ত আলোচনায় ড. বিনায়ক সেন বলেন, নিঃস্ব পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ নিংশেষ হতে চলেছে। এখন অতি দরিদ্র লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। গরিবরা এখন ধনী হতে প্রতিযোগিতা করছে বলেন তিনি। তবে শহরে বৈষম্য বাড়ছে। কোন কোন উৎস থেকে এটা বাড়ছে তা দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেন এ গবেষক।

আর বিশ্বব্যাংকের ক্সিমেনা ভিডেল কারপিও বলেন, গত দুই দশকে সরকার দারিদ্র্য দূর করার জন্য সাধারণ কাজ করেছে। কোভিড ও যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা চলমান ছিল। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ ও প্যাকেজ অর্থনীতিতে কাজে লেগেছে। আর দারিদ্র্য দূরীকরণে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপ ছিল। যেখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। বিশ্ব ব্যাংকের কারিগরি সহায়তায় ১৪ হাজার ৪০০ খানা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বিবিএস। ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিদেশী বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।