পুন্ড্র সভ্যতার ঐতিহ্যের চিকন সেমাই করোনার কারণে প্রায় তিন বছর হোঁচট খেয়েছিল। এ বছরের রমজানের ঈদে হোঁচট কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। চিকন সেমাই দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। বগুড়ার দইয়ের মতো চিকন সেমাই বগুড়ার পরিচিতি বাড়িয়ে দিয়েছে। চিকন সেমাই বলতেই এখন বগুড়া। এ সময় যারা বিদেশে যাচ্ছেন প্রবাসীদের চিকন সেমাইয়ের আবদার পূরণ করতে হচ্ছে। বগুড়ার যারা কলকাতায় যাচ্ছেন বন্ধুদেশের পরিচিতদের জন্য সঙ্গে নিচ্ছেন চিকন সেমাই। বগুড়ার চিকন (মিহি) সেমাই যাদের হাঁড়িতে একবার উঠেছে তারা এর স্বাদ ভুলতে পারেন না।
গত দুবছর রমজানের ঈদের চিকন সেমাই উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ বছর জোরেশোরে চালু হয়েছে। অতীতে গ্রামের নারী লম্বা পিঁড়িতে ময়দা ছেনে হাতের সূক্ষ্ম বুননে সেমাই বানাতেন। সেমাইয়ের এ সূক্ষ্ম বুননের যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পর সেমাই হয়েছে সুতার মতো। প্রতিবছর রমজান মাস শুরুর দেড় মাস আগে বগুড়া সদর, শাজাহানপুর, গাবতলি উপজেলার গ্রামগুলোয় চিকন সেমাই তৈরি শুরু হয়। সেমাইয়ের মূল উপাদান উন্নত মানের ময়দা বেচাকেনায় কোনো বিঘœ ঘটেনি। তবে এবার উপকরণের দাম অনেক বেশি। কারিগরের ৮০ শতাংশই নারী।
পাইকারি সেমাই যাচ্ছে বাঁশের খাঁচায় ট্রাকে। এ বছর কয়েকটি বড় কোম্পানি চিকন সেমাই প্যাকেটজাত করেছে। এ সেমাই আলাদা করে ভাজতে হবে না। আধা কেজি ও এক কেজির প্যাকেটজাত সেমাইয়ের দাম বেশি। বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের বড় বাণিজ্য হলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় সরবরাহ। বিচ্ছিন্নভাবে উড়োজাহাজে বিদেশে পাঠানো হয়। এবার এ দুইয়ের সঙ্গে দেশের পর্যটকরা ভারতেও চিকন সেমাই নিয়ে যাচ্ছেন।
বগুড়ার নির্দিষ্ট এলাকায় সেমাই পল্লী গড়ে উঠেছে। শহরতলির সাবগ্রাম, বেজোড়া, শ্যাওলাগাতি, কালিসামাটি, ফুলবাড়ি, ফুলতলা এলাকাগুলোয় শ্রমিকরা সেহরির পর কাজ শুরু করে। একটানা কাজ চলে বিকাল পর্যন্ত। চিকন সেমাই বানাতে ফ্রেশ ময়দা দরকার। সামান্য ভেজাল থাকলে টানা সেমাই ছিঁড়ে যায়। ময়দা ছেনে নেওয়ারও কৌশল আছে। শক্ত ও নরম হওয়ার হেরফেরে সেমাইয়ের মানের পরিবর্তন হয়। মাঝারি কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ কেজি করে সেমাই উৎপাদিত হয়। প্রতিদিনের উৎপাদন গড়ে তিন শ’ টন।
প্রতি কেজি সেমাই খুচরা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৪০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। গত শতকের পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগে বগুড়ার গ্রামের মেয়েদের হাতে তৈরি সূক্ষ্ম কারুকাজের চিকন সেমাই ছিল গরিবের ঈদের সেমাই। গত শতকের শেষে গরিব-ধনীর ভেদাভেদ ভুলে সকলের ঘরে পৌঁছে যায় চিকন সেমাই। একুশ শতকের শুরুতে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চিকন সেমাই এখন উঁচু আসনে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ের গর্বিত পরিচয়ে পৌঁছেছে। গ্রামের হাটবাজার থেকে নগরী-মহানগরীর শপিং মল হয়ে পাঁচ তারকা খচিত হোটেলে মেলে বগুড়ার চিকন সেমাই। চিকন সেমাই ঈদের গিফটের তালিকাভুক্তি হয়েছে।
জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে বগুড়ার পরিচিতি ‘ল্যান্ড অব পুন্ড্র সিভিলাইজেশন’। বগুড়ার দইয়ের কদর বিশ^জুড়ে। এখন বগুড়ার চিকন সেমাই তাক লাগিয়েছে। এই ডিমান্ড দেশজুড়ে। অর্থনীতির একটি সংজ্ঞায় সাপ্লাই ক্রিয়েটস ইটস ওন ডিমান্ডের মতো বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের সরবরাহ নিজস্ব চাহিদা তৈরি করেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বগুড়ায় সেমাই বানানোর আধুনিক যন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর চাহিদাও বাড়ে। বগুড়ার বাইরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের যারা ঈদে বাড়িতে আসতে পারেন না তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনের কাছে চিকন সেমাই পাঠানোর অনুরোধ জানায়। কুরিয়ার সার্ভিসসহ নানা মাধ্যমে চিকন সেমাই পাঠানোর হিড়িক পড়ে যায়।