প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং তৎকালীন শান্তিবাহিনী ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। দুই যুগের কালো অধ্যায় শেষে আলো ফেরে পাহাড়ে। শান্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া- এই বাস্তবতা স্মরণে রেখে চুক্তি বাস্তবায়নের অর্জনকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে যে কোনো মূল্যে পাহাড়ে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
সাল ১৯৭১, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণের মৌলিক অধিকারের বিস্তর ফারাক ও চাওয়া-পাওয়ার বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর জাতি হিসেবে বাঙালির স্বীকৃতি আর স্বাধীনতার স্বাদ সবেমাত্র পেয়েছিলাম আমরা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের খুঁটিগুলোকে সবেমাত্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেয়া বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরলোক গমনের সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা এদেশের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে শুরু হয় অন্য এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বাহানায় সেখানে সৃষ্টি হয় একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ‘শান্তিবাহিনী’। তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমেই অশান্ত হয়ে পড়ে। দিন-দুপুরে শান্তিবাহিনীর হাতে খুন হতে থাকে নিরীহ পাহাড়ি ও বাঙালিরা। চাঁদাবাজি, খুন, গুম, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ছিলো সেখানকার নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা। এক কথায় কয়েক হাজার নিরীহ জনসাধারণ প্রাণ হারায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে।
এই সময়টাতে অরক্ষিত সীমান্তসহ ভূখণ্ড রক্ষা ও শান্তি ফেরাতে সেখানে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এরপর সেনা-বিজিবি-পুলিশ ও আনসার মিলে দিনের বেলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও রাতের বেলা গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে বিলীন করে গণহত্যা চালাতে থাকে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা।
এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাহাড়ের সমস্যার আর সমাধান হয় না। এভাবে কেটে যায় প্রায় দুই যুগ।
১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য জেলাগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে দফায় দফায় বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা শুরু করে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশের বিধিবিধান ও আইন যথাযথ অনুসরণ করে কোনো তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তৎকালীন শান্তিবাহিনী ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়।
দুই যুগের কালো অধ্যায় শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে আলো ফেরে পাহাড়ে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ। পাল্টাতে থাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিত্র। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারের ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নানা সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের কারণে পর্যটনেও ভূমিকা রাখতে শুরু করে পাহাড়।
বর্তমান সরকার বিগত পঁচিশ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। শান্তিচুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় শান্তি আনয়নের পাশাপাশি ওই এলাকায় অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।
চুক্তি অনুযায়ী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করেছে এবং স্থানীয় সরকার পরিষদকে জেলা পরিষদে রূপ দিয়ে পাহাড়ের অভূতপূর্ব উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ‘তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর-সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন।
প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে ও শরণার্থী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা এবং ৭২৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর ২ হাজার ৫২৪ জনের বিরুদ্ধে ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৪৪টি মামলা যাচাই-বাছাই এবং এর মধ্যে ৭২০টি মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে।
একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৩৮টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন দফতরে চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের একজন সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে জারিকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিক পর্যায়েও অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ভূমিবিষয়ক আইন ও বিধিমালা ছিল না। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১ প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে, যা চলমান।
শান্তিচুক্তির আগে এডিপিভুক্ত প্রকল্প ছিল একটি। এখন সেখানে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন বাজেট দেয়া হয় ৯১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা আগে (১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে) ছিল ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ঢাকার বেইলি রোডে ১ দশমিক ৯৪ একর জমির ওপর ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স।
চুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে। আগে পার্বত্য অঞ্চলে কোনো মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল না। ট্রাইবাল স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চলমান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা বিস্তারে সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। চুক্তির আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল খুবই কম। চুক্তির পর দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পুনর্নিমাণ করা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪শ’ উপজাতি ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রয়েছে পার্বত্য উপজাতিদের জন্য। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
এক সময় পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার জন্য নানা প্রতিকূলতা জয় করে সমতলে আসতে হতো। তাদের শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। ওই এলাকায় দুর্গম হিসেবে পরিচিত বসতিতেও উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পাড়াকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা পড়ছে নিজের মাতৃভাষায়।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলায় ৮৭৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন জেলায় এ পর্যন্ত ৫৬০ কিলোমিটার (৩৩ কেভি), ৯৮৪ কিলোমিটার (১১ কেভি) ও ১৩৫৫ কিলোমিটার (৪ কেভি) বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়, এরকম লক্ষাধিক পরিবারকে ধাপে ধাপে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত ছিল না। চুক্তির সুফল হিসেবে রাতের আঁধারেও দুর্গম পাহাড়ের কুঁড়েঘরগুলোতে জ্বলছে সোলার বাতি।
চুক্তির আগে পার্বত্য অঞ্চলে মাত্র ২০০ কিলোমিটার রাস্তা ছিল। বান্দরবানের রুমা ও ধানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর ওপর কোনো সেতু ছিল না। এখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাস্তা ও বিভিন্ন আকারের সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করছে।
চুক্তির পর ১ হাজার ৫৩২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ২৫০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান এবং আরও প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
পাহাড়ি সড়কে যানবাহন চলাচলে একটা সময় ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী ‘বেইলি সেতু’ ছিল একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়াটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। মানুষের শঙ্কা ও দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্রও। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাগড়াছড়ির অধিকাংশ পাটাতনের বেইলি সেতু সরিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্থায়ী সেতু। অতিসম্প্রতি কেবল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়ই ৪২টি স্থায়ী সেতু নির্মাণ হচ্ছে। এতে পরিবর্তন আসছে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগে। ইতোমধ্যে সেতুগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
শান্তিুচুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়েছে। চুক্তির আগে তা ছিল না বললেই চলে। ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নয়নে মোবাইল অপারেটরগুলোর পাশাপাশি পাহাড়ে ব্রডব্যান্ড ওয়াইফাই-এর বিস্তার ঘটেছে। এছাড়া নেটওয়ার্কের জটিলতা নিরসন করে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ দিয়েছে সরকারি টেলিকম কোম্পানি টেলিটক।
পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রদর্শনী ক্ষেত্র স্থাপন কার্যক্রম এবং চাষী পর্যায়ে উন্নতমানের ধান-গম ও পাট বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনী ক্ষেত্র স্থাপন কার্যক্রম চলছে। কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে পাহাড়ে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে মধু, কফি, আম, কমলাসহ নানা অর্থকরী ফসল আবাদ হচ্ছে। সেসব প্রতিবছর সমতলে সরবরাহ এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সাল থেকে উপজাতিদের নিজস্ব পাঠ্যপুস্তকের আওতায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া পাহাড়িদের ভাষা সংরক্ষণে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে সাতটি শব্দকোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
পর্যটনের জন্য পার্বত্য ভূখণ্ড বরাবরই বড় সম্ভাবনা ক্ষেত্র। উন্নত সড়ক যোগাযোগ ও আবাসন সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। গড়ে উঠছে পর্যটনের অবকাঠামো।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর বর্তমান সরকারের আহ্বানে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্প ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছে। পার্বত্য জেলা শহর, নদী, সর্পিল রাস্তা, পাহাড় ও সবুজে ঘেরা সারি সারি গাছ, পাহাড়ের গুহা, ঝর্ণা, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি, জীবনধারা ও বিনোদনের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সড়কপথ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধন করছেন। তারা সাহসী ভূমিকা নিয়ে বৈরী পরিবেশে কাজ করে চলেছেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং দুর্গম পাহাড়ি পথে সড়ক নির্মাণ করে উল্লেখযোগ্য স্থানে পর্যটন শিল্প উন্নয়নে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং রাত যাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় এখন সৌন্দর্য পিপাসু হাজারো মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে।
জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে স্বতন্ত্র কোভিড ইউনিটে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, ফ্লু কর্নার, আরটিপিসিআর ল্যাব, বেড সাইড সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ, বহির্বিভাগ সেবা, শিশুবিকাশ কেন্দ্র (অটিজম রোগীদের সেবাসহ), অন্তর্বিভাগ সেবা, জরুরি বিভাগ সেবা, সার্জারি, নবজাতকের জন্য শেখ রাসেল স্কেন্যু সেবা, মাতৃ স্বাস্থ্য সেবা, প্রসব পূর্ব ও পরবর্তী সেবা, নরমাল ডেলিভারি (২৪ ঘণ্টা), সিজারিয়ান সেকশনে (২৪ ঘণ্টা) সেবা দেয়া হচ্ছে।
এর পাশাপাশি রোগ নির্ণয়, প্যাথলজি বিভাগ, এক্স-রে বিভাগ, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, জরায়ু ক্যান্সার শনাক্তকরণ (ভিআইএ), নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রম, পুষ্টি সেবা (আইএমসিআই), সমাজ সেবার রোগী কল্যাণ কার্যক্রম, ওসিসি (সারভাইবলদের সহায়তা) প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
এর বাইরে দুর্গম এলাকাগুলোতে নিয়মিত চক্ষু সেবা ক্যাম্প, মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনসহ নানাভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে সেনাবাহিনী। সব ছাড়িয়ে করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রমে নিজেদের হেলিকপ্টার ব্যবহার করে পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় পাহাড়িদের টিকা দিয়ে অভাবনীয় প্রশংসা কুড়িয়েছে সেনাবাহিনী।
শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে সরকার ও সেখানকার আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কমে এসেছে চাঁদাবাজি। বেড়েছে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি। আগে যেখানে দিন-দুপরে গাড়ি থামিয়ে, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে, অপহরণ করে বিরাট অঙ্কের চাঁদাবাজি হতো সেখানে তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। একটা সময় ছিলো, পাহাড়ি সড়কে বিকেল ৩টার পর কোনো যানবাহন চলাচল করতো না সন্ত্রাসীদের ভয়ে। সেখানে আজ ২৪ ঘণ্টাই বিলাসবহুল গাড়ি চলাচল করছে, যা শান্তিচুক্তির অভাবনীয় সাফল্য।
শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে এসে কী পরিবর্তন হলো পাহাড়ের? জানতে চেয়েছিলাম কয়েকজনের কাছে। কেউ বলছেন বান্দরবান এলাকায় নির্মিত বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ৭২ কিলোমিটার সড়কের কথা। কেউ বলছেন, মেডিক্যাল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জনপ্রত্যাশা পূরণ করেছে। তবে সাধারণ মানুষ বলতে চাইছেন, পার্বত্য ভূখণ্ডে এমন অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেখানে পাকা সড়ক নির্মাণ কখনও হবে এমনটি ভাবনায় আসত না। এখন তা বাস্তব। মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত নির্মিত সীমান্ত সড়কের কথাও বলছেন অনেকে।
কেউ বলেন বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল-ইন্টারনেট সেবার কথা। কারও বিবেচনায় সরকার তো রেলপথ নির্মাণের কথাও ভাবছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিপাশ্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা শুনতে পাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, এটা অনেকের ভাবনায় না এলেও চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে এসে আজ তা এক বাস্তবতা।
চুক্তি এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে শুরুতে উপকারভোগীদের মধ্যে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ চুক্তির কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি জাতীয় মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে উন্নয়ন-অবকাঠামো দিন দিন বিকশিত হচ্ছে পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রচেষ্টায় শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সবাই একযোগে কাজ করতে পারলে শান্তির পথ সুগম হবে।
সত্যিকার অর্থে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয় তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার মাত্র এক বছরের মাথায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি মূলত তার লক্ষ্যের প্রথম ধাপ অর্জন করেছিলেন।
একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি একদিকে যেমন চুক্তির কিছু ধারা দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন, তেমনি টেকসই পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে মাথায় রেখে কিছু ধারা বাস্তবায়নের জন্য ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সীমান্তবর্তী নানা অপতৎপরতা, দেশের অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদীদের নীরব উৎপাত এবং বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অপরাধপ্রবণতা- এসব কিছুই পাহাড়ের শান্তি ও সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এমনকি রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি হতে পারে বাধাগ্রস্ত। ভুলে গেলে চলবে না, শান্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই এই বাস্তবতাকে স্মরণে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ২৫ বছরের অর্জনকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে যে কোনো মূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে পাহাড়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: লে. কর্নেল মাসুদ পারভেজ চৌধুরী, পিএসসি